গল্ফ ক্লাব রোডের যে বাড়িটায় ছোটবেলায় থাকতাম, তার নাম ‘ফিল্ম সার্ভিস’। নীচে ফিল্ম ল্যাব, এডিটিং আর প্রজেকশন রুম, সিনেমার বহু লোক সেখানে আসতেন। বাড়ির ওপরতলাটায় সব সময় নাচ-গানের মহলা চলছে, আর নীচে সিনেমা। ছোট বয়স থেকেই নানান ছবিতে অভিনয়ের অফার পেয়েছি। কিন্তু বাবা-মা চাননি অত কম বয়সে আমি অভিনয় করি।
মৃণাল সেনের তিনটে ছবিতে আমার দাদা আনন্দশংকর মিউজিক দিয়েছিলেন। মৃণালদার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত, বলতেন: যদি কখনও ভাবো অভিনয় করবে, জানিয়ো। আমিও প্রমিস করেছিলাম, আপনার ছবিই হবে আমার প্রথম ছবি। আমার নাচের অনুপ্রেরণা আমার মা, আর অভিনয়ের, বাবা। ছোটবেলায় খুব ঘ্যানঘেনে ছিলাম, বাবার কাছে গিয়ে বলতাম, ভাল্লাগছে না... বাবা বলতেন, আয়নার সামনে বসে এই ‘ভাল্লাগছে না’টাই কত ভাবে বলতে পারো, দেখি। কখন নর্মাল বলছি, কখন কনশাস হয়ে যাচ্ছি, উনি ধরিয়ে দিতেন। যখন কলেজে পড়ি, এক দিন মৃণালদাকে বললাম, আমার এখন অনেক সময়, কোনও কাজ থাকলে বলবেন। উনি বললেন, একটা ছবির কথা ভাবছি, একটা সাঁওতাল মেয়ের চরিত্র। বললাম, সাঁওতাল মেয়ের সঙ্গে তো আমার কোনও মিল নেই! মৃণালদা বললেন, এক দিন এসে তোমার মেক-আপ টেস্ট করাব। মেক-আপ ম্যান দেবী হালদারকে নিয়ে, এলেন। আমার মুখ-হাত-পা সব কালো রং করিয়ে ছবি তোলালেন। ছবি দেখে আমি বললাম, মৃণালদা, আমি মেক-আপ করব না, রোদে পুড়ে কালো হব। বললেন, পারবে? শুরু হল আমার কালো হওয়ার প্রস্তুতি। খাওয়া-ঘুমটুকু বাদে বাকি পুরো সময়টা রোদে বসে থাকতাম, নুন-জল বা গ্লিসারিন মেখে।
কথা চলছিল, হিরো কে হবে। মৃণালদা এক দিন জানালেন, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে দারুণ একটা ছেলেকে পাওয়া গেছে। নাম মিঠুন চক্রবর্তী। ছবিও দেখালেন। আমরা অবাক! ঘাড় অবধি বড় বড় চুল, একটা রঙিন স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর ব্লু জ্যাকেট আর বেলবটম প্যান্ট পরা, এ করবে সাঁওতাল ঘিনুয়া-র রোল!
’৭৫-এর ডিসেম্বর, শুটিং ম্যাসাঞ্জোরে। চিরকালই আমার অদৃষ্টে বিশ্বাস, দেখলাম, এ ছবির সঙ্গে ‘ম’-অক্ষরটার কী অদ্ভুত যোগ! ছবির নাম মৃগয়া। পরিচালক মৃণাল সেন। তার পর আমরা: মিঠুন, মমতা। ক্যামেরাম্যান মহাজন (কে কে মহাজন), স্ক্রিপ্টরাইটার মোহিত চট্টোপাধ্যায়। শুটিং ম্যাসাঞ্জোরে, থাকছি ময়ূরাক্ষী ভবনে!
ম্যাসাঞ্জোর গিয়েই মৃণালদা মিঠুনের মেক-আপ নিয়ে পড়লেন। শেষে যখন মিঠুন বেরল, একটা খাটো ধুতি পরনে, খালি গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়ানো শুধু। চুলটা একদম ছোট করে কাটা। সামনে এসে দাঁড়াতেই আমার মনে হল, ও ঘিনুয়া ছাড়া কেউ না!
শুটিংয়ে কারও কোনও মেক-আপ নেই। আমার মা সঙ্গে গেছিলেন, মৃণালদাই বলেছিলেন যেতে। মা-ই রোজ চুলে তেল দিয়ে, হাতখোঁপা করে দিতেন। সাঁওতালদের গায়ে উল্কি থাকে, সবুজ ফেল্ট পেন দিয়ে মা-ই রোজ আমার গলায় উল্কি এঁকে দিতেন। আমার পোশাক বলতে একটা লুঙ্গি আর গায়ে একটা গামছা। কোনও অন্তর্বাস নেই, একটা সেফটিপিন না। এক বারও মনে আসেনি যে আমি এত স্বল্প পোশাক পরে আছি। আমার বাড়ি থেকেও কোনও আপত্তি ওঠেনি। ওঁরাও বুঝতে পেরেছিলেন, যে জনজাতির আমি প্রতিনিধিত্ব করছি, এই পোশাক তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
রোজ শুটিং স্পটে যাই, ডাক আর পড়ে না। মৃণালদা খুব নাম ভুলে যেতেন, মিঠুনকে ডাকতেন ‘ছেলেটা’, আমায় ডাকতেন ‘মেয়েটা!’ হঠাত্ এক দিন বললেন, এই মেয়েটা, শোনো, তুমি ওইখান থেকে ওই মাটির কলসিটা নেবে, ওই ঝোরাটা থেকে জল ভরবে, ওই দিকে চলে যাবে। বুঝেছ? আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বলে দিলেন, স্টার্ট সাউন্ড! ক্যামেরা! অ্যাকশন! আমি মেশিনের মতো করে গেলাম সব। মৃণালদাও বললেন, কাট! ভেরি গুড! কিছু বোঝার আগেই হয়ে গেল আমার জীবনের প্রথম শট।
এক দিন বললেন, তোমার চরিত্র ডুংরির সঙ্গে জমিদারের একটা রেপ সিন আছে। শুনে আমি ভয়ে কাঠ। শুধু ভাবছি, পোশাক তো ওই! রেপ সিনে ধস্তাধস্তি হলে কী হবে! যে দিন ওটার শুটিং হবে, মৃণালদা বললেন, তুমি ওই কাঠ-ভর্তি ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে হেঁটে আসবে। তিন পা এসে, হঠাত্ একটা কিছু দেখে খুব ভয় পেয়ে আঁতকে উঠবে। করলাম। মৃণালদা বললেন ‘প্যাক আপ!’ আমি শুকনো মুখে বললাম, ওই সিনটা হবে না? মৃণালদা বললেন, এই তো, হয়ে গেল! কিচ্ছু বুঝলাম না। অনেক পরে পরদায় দেখেছিলাম, এই শটটার পর ক্যামেরা জমিদারের মুখটা ধরে, আর শোনা যায়, ‘ওকে বাঁধো। পালকিতে ওঠাও। দরজা বন্ধ করো।’ শুধু ডাবিংয়ের সময়, সুহাসিনী মুলে আমার মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে ছিল, আর আমি চেঁচাচ্ছিলাম। জমিদারের মুখের ওপর শট, আর সাউন্ড এফেক্ট মিলে একটা অসাধারণ দৃশ্য তৈরি হল পরদায়।
ডুংরি-ঘিনুয়ার বিয়ের সিন। গ্রামের লোক অত সিনেমাটিনেমা বোঝে না, ধরে নিয়েছে সত্যি সত্যি বিয়ে। ওদের বিয়ের রীতিমাফিক আমাকে ও মিঠুনকে দুটো আলাদা বাড়িতে বসিয়ে রাখল, মুড়িটুড়ি কী সব খাওয়াল। তার পর দুজনকে ঝুড়িতে বসিয়ে নিয়ে এল বিয়ের আসরে। মৃণালদাও কিছুতে না করেননি, অ্যাত্ত রেসপেক্ট দিয়েছিলেন ওঁদের! আর বিয়ের রাতের সিনটা! ঘিনুয়া আর ডুংরির মুখে ঘুরে-ফেরে কয়েকটা মোটে শব্দ, তাতেই কী মিষ্টি একটা বিয়ের রাত নেমে আসে পরদায়! আজ যখন কেউ বলে বাংলা ছবি পরিণত হচ্ছে, খুব হাসি পায়। তা হলে এই ছবিগুলো কী ছিল! এখনকার ছবিতে তো সব আন্ডারলাইন করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়! আগেকার ডিরেক্টর থেকে দর্শক, সবাই বরং ঢের বেশি পরিণত ছিলেন।
কী যে ভাল ছিল শুটিং-এর দিনগুলো! অসামান্য সব মানুষ, পিকনিকের মতো শুটিং, রাতে নাচ, একসঙ্গে খাওয়া। সব চরিত্রের ডায়লগ আমার মুখস্থ ছিল। এখন তো, সেটে গেলেই মনে হয়, উফ, ডিরেক্টর কখন ‘প্যাক আপ’ বলবে! আর তখন মনে হত, ভগবান, মৃণালদার মাথায় যেন আর একটা সিন আসে, মৃণালদা যেন ‘প্যাক আপ’ কথাটা না বলেন!
msdc2008@gmail.com