‘হুগো’ সিনেমায় রেলস্টেশনের খেলনার দোকানটা ছিল রূপকথার দেশের মতো।
টগবগবগ, ক্রকক্রাক ক্লকক্লাক— খুরের আওয়াজ শুরু হতেই কে যেন চিৎকার করল, ওরে বিবি সরে দাঁড়া আসছে আমার পাগলা ঘোড়া। আমিও তড়াক লাফে সরে গেছি। ঘোড়ামশাই এগিয়ে আসছেন, পিঠে দাঁত কিড়মিড়ে সান্ত্রিমশাই হাতে তরোয়াল উঁচিয়ে পেট ফুটো করতে রেডি আছেন। আমি বেঁচে গেলাম বটে কিন্তু একটা বেজায় বড় ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে ঘোড়ামামা সওয়ারিশুদ্ধু পপাত ধরণীতল হলেন। ধমাস এবং ধপাস। কিন্তু এত বড় অ্যাক্সিডেন্টের পরও কোনও হতাহতের খবর নেই। ট্রাকটাকে আবার সোজা করে দেওয়া হল। ঘোড়াআংকেলকেও সেপাইসমেত তুলে দেওয়া হল। তিনি ‘নতুন দম’ নিয়ে আবার অন্য দিকে ছুটতে শুরু করলেন।
এই সব অসম্ভব সম্ভব হচ্ছে খেলনার জগতে। এঁরা হচ্ছেন গিয়ে প্লেন অ্যান্ড সিম্পল কলের খেলনা। শপিং মলে, তাগড়াই, চেকনাইওয়ালা রংবেরঙের শোরুমে এঁদেরকে তোমরা পাবে না। অত ঠান্ডা, অত ফর্মাল কথাবার্তা এনারা তেমন সহ্য করতে পারেন না কিনা। তাই এঁরা সবাই মিলে রাজত্ব করেন ফুটপাথে, খোলা আকাশের নীচে, বন্দুক আর বেলুন-এর স্টলের পাশটাতে। মেলার পথে-ঘাটে। সেখানে, কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য, সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকে শুরু করে, আকবরের আমল ঘুরে, হালের লস অ্যাঞ্জেলেসের অব্দি সব জিনিসপাতি পাওয়া যায়। আলপিন টু এলিফ্যান্ট।
যেমন, মান্ধাতার আমলের দাবার বোর্ড (পাশা নয়তো?), ঝকমকে শান দেওয়া সোনালি তরোয়াল (দেখলে অরুণ, বরুণ, কিরণমালাদের বলেই মনে হয়), চোখা-চোখা তির ধনুক (ওটা শিয়োর একলব্যের), দুর্যোধনের গদা, তার পাশেই লিয়োনার্দো দি ক্যাপ্রিয়ো’র ডুয়েল লড়ার পিস্তল (টিপলে বলবে, ফায়ার, ফায়ার। তার পরেই ঠাঁইঠাঁইঠাঁই করে লেজার আলো ছোড়ে)! পাকাগুলো বলিউডও গুলে খেয়েছে। সত্তর দশকে লায়ন, শাকাল প্রমুখ ভিলেনের আখড়ায় যেমন থাকত, তেমন ডার্টবোর্ড রেখেছে। হেলিকপ্টার, এরোপ্লেন। আওয়াজ হবে, উড়বেও। জন্তুদের তো পৌষমাস। গায়ে ছিটছিট লিকলিকে রবারের সাপ। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কীসের স্ক্রু লাগানো ঈশ্বর জানেন। লেজ ধরলেই এ দিক-ও দিকে বেঁকে-চুরে লাল জিভ বার করে ভয় দেখাচ্ছে। সুতো ধরে টান দিলেই তড়বড় করে ‘তবে রে, তবে রে’ ভঙ্গিতে তেড়ে আসছে কুমির। ভাগ্যিস সে কাগজের! একটা প্যাকেটের মধ্যে আস্ত চিড়িয়াখানা হাজির। বাঘ-সিংহ থেকে ডাইনোসর। আর্কিওপটেরিক্স থেকে পেঙ্গুইন। ও দিকে গরু-ছাগল থেকে টিকটিকি। ইস্। লাস্টের’টা এত সত্যি দেখতে, পাশে জ্যান্ত একখানা এসে শুয়ে থাকলে কী ভেবে কীসে যে হাত দিয়ে ফেলবে! ওয়াক্ ওয়াক্।
অ্যাই, পালিয়ো না। ভাল ভাল কথা বলব এই বার। রেল লাইন আর ছোট্ট ছোট্ট কামরা পাওয়া যাচ্ছে বুঝলে। আমি বেশ কয়েক বছর আগে এক বার কিনেছিলুম। সঙ্গে ওখান থেকেই ক’টা ইয়া ইয়া ব্রিজ, ঝাঁকড়া গাছ, ছোট্ট ছোট্ট মানুষ, বার্বি পুতুলের তকতকে বাংলো, রেসিং কার-ও কিনে আনলাম। তার পর তো ঘরের কার্পেট হটিয়ে আস্ত একখানা শহরই বানিয়ে ফেলেছি। গাড়ি-বাড়ি, কারখানা-ক্রেন, বড় পুকুর (জলের গামলা বসিয়ে তাতে টিনের ভটভটি চালিয়ে দিয়েছি, ব্যস), চার পাশে কুঝিকঝিক করে রেল চলেছে। পিচবোর্ড দিয়ে পাহাড় বানিয়েছি, রেল লাইনের ওপর প্যাকিং বাক্স বসিয়ে গুহাও করে দিয়েছি। এক পাশে টিরানোসরাস রেক্স হাঁ পেতে দাঁড়িয়ে।
তা, মডেল শহর বানাতে খাটনি আছে। তোমরা বরং গানের ব্যান্ড বানাও। ফোক কিংবা রক। এখানে একতারা, ঢাক-ঢোল, বাঁশির পাশাপাশি, কর্ডলেস মাইক, ইলেকট্রিক স্পার্ক মারা গিটার, ড্রামবাদক ছোটা ভীম, ইলেকট্রনিক কিবোর্ড, পিয়ানো সবই পেয়ে যাচ্ছ তো। ২০ টাকা বাজেট রাখলে গ্যাস, প্রেশার কুকার, জলের জাগ, ফ্রিজ, বঁটিসহ আস্ত রান্নাঘর হয়ে যাবে। ওওওওওও আন্টি, আপনি কোমরে আঁচল গুঁজে কোথায় ছুটে বেরোচ্ছেন? দাঁড়ান, দাঁড়ান, খেলনার কথা হচ্ছে এখানে। বসুন, বসুন।
ধ্যাত্, গুলিয়ে দিলে সব! ওহ্, বায়োস্কোপ বক্স আছে, জানো? ধরো, হাত-সমান চৌকো বাক্স, ফুটোয় চোখ রাখলে, অমনি সামনে আজব দুনিয়া খুলে গেল। এই দেখলে নাক লম্বা কাঠের খোকা বুরাতিনো আর নীলকেশী কন্যে মালভিনা, পরের সিনেই পাপেট মুভিতে সিন্দবাদ ঘুমন্ত অজগরের লেজ আলগোছে সরিয়ে মুক্তো তুলছে, তার পর এত বড় বড় থোকা থোকা ফুলের মধ্যে আনারকলি নাচছে, হঠাৎ নাচ বন্ধ হয়ে জনি ডেপ বিনুনিওয়ালা জলদস্যু সেজে প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে এসে এঁকেবেঁকে বলল, ‘ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো, মাদাম।’ পরের ডায়লগ, ‘পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা’। প্রচণ্ড চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শয়তান মার্কা হাসছে ব্যাটম্যানের জন্মশত্তুর জোকার। তার ছবি আটকানো একটা প্রকাণ্ড বেলুন থেকে। হানা মন্তানা, মাইকেল জ্যাকসন, বেন টেন আর চাচা চৌধুরী আঁকা বেলুনও উড়ছে। ওগুলোরই দাম হাঁকছিল খেলনাওয়ালা।
তার থেকেই চুইংগাম কিনলাম। একটা বার করতে গিয়েই চিড়িক শক খেলাম। বাকি আর কিছু বলার ক্ষমতা নেই বাবা, মেলায় ঘুরে ঘুরে আমি এখন পুরোদস্তুর চমকপ্রুফ। ও দিকে শীত পড়ছে, আরও মেলা বসবে। আম্মো তক্কে তক্কে আছি। বোঝাই যাচ্ছে, যা খুঁজছি ও জিনিস শুধু এ সব মেলাতেই পাব। ভূতের রাজা তাঁর জুতোজোড়া রিপেয়ার করেছেন শুনেছ তো? তাতে এখন টাইম-ট্রাভেলও হচ্ছে। ওটা যে খুঁজে দরদাম কষে কিনতে পারবে তাকে ফ্রি দেবেন মার্বেলের গুলির মতো দেখতে দুটো আসলি বাঘের চোখ। আর গুলতাপ্পি বলে ঘাড় ঝাঁকালেই, ফুটিয়ে দেবেন নেকড়ের নখ।