ছবি: সুমিত্র বসাক।
টিং-টং, টিং-টং। ছুট্টে এসে দরজা খুলল তপু। দরজা খুলতেই আগন্তুককে দেখে ওর খুব রাগ হল। পাড়ার প্রমোদআঙ্কল। এই মফস্সলের উদীয়মান প্রোমোটার। ‘দামোদর শেঠ’ মার্কা ভুঁড়ি। গলায় সোনার চেন। পানের রসে সিক্ত মোটা ঠোঁটের কোণে ‘মন ভোলানো হাসি’। ‘কেমন আছ তপু?’ ‘দিস ইজ ফর ইউ’, বলেই পকেট থেকে একটা ক্যাডবেরির প্যাকেট বের করে তপুকে দিল। ‘বাবা বাড়িতে আছেন?’ তপু চোখের ইশারায় প্রমোদআঙ্কলকে ঘরে যেতে বলল। রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল তপুর। অবশ্য এর একটা পোক্ত কারণ আছে। তপুর ‘মিশন ম্যাঙ্গো অরচার্ড’-এর প্রধান শত্রু এই প্রমোদআঙ্কল।
দাদু আর বাবার সামনে বসে রঙিন স্বপ্নের ‘ফুলঝুরি’ জ্বালাবে। ধীরে ধীরে তাঁদের হিপনোটাইজড করে আসল কথাটা খুলে বলবে। হ্যাঁ, ঠিক তাই। ঘরের ভেতরে সে রকম কথাবার্তাই চলছে। তপুও দাঁড়িয়ে সে সব শুনছে। তপুর ‘রাগ রাগ’ মুখের দিকে তাকিয়ে দাদু বললেন, ‘হ্যাঁ, সবই তো বুঝলাম তবে...।’ কথা শেষ হতে না হতেই প্রমোদআঙ্কল বললেন, এই তো বাঙালির তিন নম্বর হাত, অজুহাত। আমি অ্যাডভান্সের টাকা সঙ্গে এনেছি। কড়কড়ে ক্যাশ।’ কথাটা শেষ করে আঙ্কল, সঙ্গে আনা ব্রিফকেসটা খুলে টি-টেবিলের উপর রাখলেন। দাদু বললেন, ‘না, না, প্রমোদ এখন থাক।’ অগত্যা উঠে দাঁড়ালেন প্রমোদআঙ্কল। আজ যাচ্ছি তবে আবার আসব। ভাল করে ভেবে দেখুন। লাভের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবেন না।’ কথা শেষ করে আঙ্কল চলে যেতেই তপু ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
যেমন করেই হোক ম্যাঙ্গো অরচার্ডটাকে বাঁচাতে হবে। তবে এ বছরটাই লাস্ট চান্স। দাদু বলেছেন, এ বছরও যদি আম না ফলে, তা হলে বাগানটা প্রোমোটারকে বেচে দেবেন। এই বাগানের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তপু বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিক, খেলা, অনুষ্ঠান করেছে। শুধু তাই নয়, বাবার ছোটবেলারও স্মৃতি রয়েছে এখানে। তপুর চোখের একটা সমস্যা হয়েছিল। ডক্টর বলেছিলেন, ‘তপুকে যতটা সম্ভব সবুজ পরিবেশে রাখবেন।’ তাই তপুরও শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে এই বাগানে।
অথচ এখন, এই বাগান, বাড়ির সকলের কাছে মূল্যহীন। গাছে ফলন হয় না। পাতা পোকায় খাওয়া। পাড়ার কুকুর বিড়াল মরলে এখানেই সবাই ফেলে দিয়ে যায়। এখন এই বাগান-জমিটার প্রতি অনেকের নজর রয়েছে। এই নীল গ্রহের ওপর থেকে সবুজ আঁচল দ্রুত হারে সরে যাচ্ছে। তপু জানে একটা সবুজ বাগানের অপরিসীম গুরুত্ব। স্কুলের বইতে, প্রজেক্টের খাতায়, অনুষ্ঠানে, বক্তৃতায় সবুজকে রক্ষা করার কত ভাল ভাল কথা শোনা যায়। অথচ স্কুলের গণ্ডি পেরোলেই এ সব কিছু কোনও এক জাদু বলে ভ্যানিশ হয়ে যায়। আচ্ছা, এই প্রমোদআঙ্কল, বাবা, দাদু সবাই তো স্কুলে পড়েছেন। কিন্তু কেউ তো কিছু বুঝতে চাইছেন না। অর্থের কাছে সব কিছুই কি অর্থহীন?
সন্ধেবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যাতারার দিকে তাকিয়ে তপু ভাবছিল কী ভাবে ‘মিশন ম্যাঙ্গো অরচার্ড’-এর প্রধান শত্রুকে হারানো যায়। তপু তো একা। তবুও ওর মনে মনে একটা জেদ চেপে গেছে। সে একমনে প্রার্থনা করছিল। এমন কোনও শক্তি নেই, যা তাকে এ কাজে সাহায্য করতে পারে? ঠিক তখনই ওর এক অদ্ভুত অনুভূতি হল। চার পাশ থেকে যেন কোনও শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে ওর মধ্যে। তবে কি কিছু ঘটতে চলেছে? হঠাৎ অন্ধকার আকাশ থেকে তারা খসার মতো নেমে এল এক আলোকবিন্দু। সোজা নেমে গেল নীচের আমবাগানে। সত্যিই তো, আমবাগানে ওটা কীসের আলো? তপুর মধ্যে তখন অসীম সাহস। সবার অলক্ষে সে একা একাই আমবাগানে চলে এল। চমকে উঠল তপু। বাগানের মাটিতে একটা মাঝারি মাপের গর্ত। তা থেকে আলো বের হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর এক জন বেরিয়ে এল ওই গর্ত থেকে। ওকে দেখে তপু রীতিমতো থ! হুবহু আর এক জন তপু। কে তুমি? অচেনা তপু হেসে উত্তর দিল, আমি তোমার উইল পাওয়ার। কনগ্রাচুলেশন ‘মিশন ম্যাঙ্গো অরচার্ড সাকসেসফুল।’ তপু বলল, তুমি কোথা থেকে কী ভাবে এসেছ? এখানে এসে তুমি কী এমন করলে যে আমার মিশন সাকসেসফুল? অচেনা তপু হেসে বলল, ‘তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তুমি এখন একটা কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক হয়ে আছ। লেট মি ক্লিয়ার নাও।’ অচেনা তপু বলতে শুরু করল। তুমি তো জানো, ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার। এনার্জিকে তৈরি করা যায় না, কিন্তু রূপান্তর করা যায়। তুমি তোমার প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে কনসেনট্রেশনের মাধ্যমে এক অদৃশ্য এনার্জি বল-এ রূপান্তর করেছিলে। তারই প্রতিরূপ আমি। আমি এই গর্তের মাধ্যমে মাটি আর গাছেদের মধ্যে এনার্জি ট্রান্সফার করেছি। মাটি ও গাছগুলি এখন অনেক বেশি অ্যাকটিভ। এ বার থেকে এই বাগানে দারুণ আম ফলবে। বিদেশেও সেই আম রফতানি হবে। অর্থ রোজগার করলে এ বাগান তো আর অর্থহীন হবে না? সো ইয়োর মিশন ইজ সাকসেসফুল। ইচ্ছা থাকলে সব কিছুই সম্ভব। আজ চলি। আবার দেখা হবে।
অচেনা তপু চলে যেতেই
হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল বাগান। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ওই দূর আকাশে মিটমিট করছে অসংখ্য নক্ষত্র। তপুর দৃষ্টি তার চেয়েও দূরে। অচেনা, অজানা কোনও নক্ষত্রলোকে।