রাজকন্যার বিয়ে

লালনপুরের রাজামশাই অঘোরচন্দ্র তাঁর রানিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানেই হাসিখুশি মেয়েটিকে দেখে রানিমার খুব পছন্দ হয়ে যায়। রানিমা ভাবেন, এই সুন্দরী মেয়েটিকে যদি তাঁর পুত্রের জন্য বধূ করে ঘরে আনতে পারলে, ভালই হত! মহারাজকেও দেখালেন মেয়েটিকে। মেয়েটি প্রতিবেশী রাজ্য পালনপুরের রাজকন্যা। প্রতিবেশী হলেও রাজ্যটিতে কোনও দিনই যাওয়া হয়নি অঘোরচন্দ্রের।

Advertisement

সমীরকুমার ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

ছবি: সুমিত্র বসাক

লালনপুরের রাজামশাই অঘোরচন্দ্র তাঁর রানিকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানেই হাসিখুশি মেয়েটিকে দেখে রানিমার খুব পছন্দ হয়ে যায়। রানিমা ভাবেন, এই সুন্দরী মেয়েটিকে যদি তাঁর পুত্রের জন্য বধূ করে ঘরে আনতে পারলে, ভালই হত! মহারাজকেও দেখালেন মেয়েটিকে।

Advertisement

মেয়েটি প্রতিবেশী রাজ্য পালনপুরের রাজকন্যা। প্রতিবেশী হলেও রাজ্যটিতে কোনও দিনই যাওয়া হয়নি অঘোরচন্দ্রের। তবে লোকমুখে রাজপরিবারটির প্রশংসা শুনেছেন। মেয়েটি পড়াশোনাতেও অত্যন্ত মেধাবী।

অঘোরচন্দ্র পরদিনই পালনপুরের মহারাজ হারানচন্দ্রকে চিঠি লিখে জানালেন, হারানচন্দ্র রাজি থাকলে তিনি অনতিবিলম্বেই শুভকার্য সমাধা করতে ইচ্ছুক। দিন কয়েকের মধ্যেই উত্তর এল। হারানচন্দ্র সম্মতি জানিয়ে আমন্ত্রণ জানালেন অঘোরচন্দ্রকে।

Advertisement

এক শুভদিন দেখে মহারানি ও অন্যান্য কয়েক জন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে অঘোরচন্দ্র রওনা দিলেন পালনপুরের উদ্দেশে। তাঁদের গাড়ি পালনপুরে প্রবেশ করতেই রাজা-রানি দু’জনেই মুগ্ধ হলেন। ঝাঁ-চকচকে রাস্তাঘাট। পথের দু’ধারে রংবেরঙের ফুলের গাছ। রাস্তায় নেই কোনও ট্রাফিক জ্যাম। পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, লোক জন দিব্যি যাতায়াত করছে। সিগনাল লাল দেখলে দাঁড়িয়ে থেকে সবুজ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। তাঁর রাজ্যের মতো চলন্ত গাড়িকে হাত দেখিয়ে বিপজ্জনক ভাবে রাস্তা পেরোচ্ছে না কেউ।

বিস্ময়ে অঘোরচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘বাঃ, খুব সুন্দর রাজ্য তো।’

দুপুরেই পালনপুর রাজবাড়িতে পৌঁছে গেলেন তাঁরা। অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এলেন হারানচন্দ্র। নিয়ে গেলেন রাজবাড়ির অন্দরে। দুপুরের আহারপর্ব সমাধা হলে রাজকন্যার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে ফিরে যাওয়ার আগে হারানচন্দ্রকে তাঁর রাজ্যে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন অঘোরচন্দ্র।

এক পুণ্যদিনে যাওয়া ঠিক হল। ওই দিন বেশ ভোরেই আত্মীয়স্বজন, লোক-লস্কর নিয়ে লালনপুরের দিকে রওনা দিলেন হারানচন্দ্র।

সে দিন সকাল থেকেই ছিল মেঘলা। লালনপুর ঢোকার পরই বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। থেমেও গেল। কিন্তু তাতেই পুরো রাস্তাটা জলে থইথই করতে লাগল। গাড়ি যে জোরে চলবে সে উপায়ও নেই। কেননা, পুরো রাস্তাটাই খানা-খন্দে ভর্তি।

পালনরাজের কনভয় একটু এগোতেই শুরু হল ট্রাফিক জ্যাম। যদিও বা একটু এগোতে যায়, হারানচন্দ্র দেখলেন, সেই চলন্ত গাড়িগুলিকেই হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিব্যি রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে লোকজন। সিগনালের কোনও তোয়াক্কাই করছে না। এ ভাবে রাস্তা পারাপারে যে বিপদ ঘটতে পারে, সে দিকে কারও ভ্রুক্ষেপও নেই।

হারানচন্দ্র অবাক হলেন দেখে যে ফুটপাতগুলির বেশির ভাগ অংশই হকার আর দোকানিদের দখলে। যেটুকু জায়গা খালি আছে, সেখান দিয়ে ভাল ভাবে হাঁটাচলা দুঃসাধ্য। অনেকেই তাই ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে চলাচল করছে। এতে গাড়িগুলির গতি হয়েছে আরও কম।

খিদেও পেয়েছে। সেই কোন সকালে খেয়ে বেরিয়েছেন। এ দিকে গাড়ি যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে কখন রাজবাড়ি পৌঁছবেন, কারও জানা নেই।

যেতে যেতে হঠাৎ হারানচন্দ্র দেখলেন, একটা দোকানে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। গরম গরম জিলিপি দেখেই খাবার ইচ্ছে হল তাঁর। গাড়ি থামিয়ে আদেশ করলেন এক কিলো জিলিপি আনার। আদেশ পাওয়ামাত্রই এক জন রাজকর্মচারী বড় পলিথিনের প্যাকেটে জিলিপি এনে হাজির করতেই আঁতকে উঠলেন মহারাজ— ‘অ্যাঁ, পলিথিনের প্যাকেটে খাবার!’ এই বস্তুটি তো নিষিদ্ধ তাঁর রাজ্যে। ধরা পড়লে জেল ও জরিমানা দুই-ই। সবচেয়ে বড় কথা এতে করে খাদ্যদ্রব্য এনে খাওয়া তো স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। মহারাজ জিলিপি আর খেলেনই না। পেটের খিদে যেমন ছিল, তেমনই রইল।

যেতে যেতে মহারাজ আরও দেখলেন, রাস্তার দু’ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্লাস্টিক। কোথাও বা ড্রেনের মুখ আটকে রয়েছে প্লাস্টিকে।

থইথই জল পেরিয়ে তিন ঘণ্টার পথ সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় অতিক্রম করে রাজবাড়িতে পৌঁছলেন তাঁরা।

খবর পেয়েই রাজা-রানির সঙ্গে যুবরাজও এগিয়ে এল হারানচন্দ্রকে স্বাগত জানাতে। যুবরাজকে বেশ পছন্দ হল। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চেহারা। অমায়িক কথাবার্তায়।

সে দিন গল্পগুজবের পর খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে হারানচন্দ্র বললেন, ‘তা মহারাজ, যৌতুক হিসেবে কী দিতে হবে আমায়?’

যেন শব্দটি প্রথম শুনছেন এমন ভাবে বললেন অঘোরচন্দ্র, ‘আপনার সুশ্রী, মেধাবী কন্যাটিকে আমি পুত্রবধূ করে ঘরে আনব। এতে যৌতুকের প্রশ্ন উঠছে কেন? কোনও যৌতুক লাগবে না। তবে হ্যাঁ, আপনার কন্যাটির যদি আমাদের কাছে কোনও প্রত্যাশা থেকে থাকে, তা হলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।’

হারানচন্দ্র একমুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তার পর বললেন, ‘মহারাজ ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল, যে রাজ্যেই ওর বিয়ে হোক না কেন, সেখানকার রাস্তাঘাটগুলির অবস্থা যেন ভাল হয়, ফুটপাতগুলি যেন মানুষের চলাচলের উপযোগী হয়। যেখানে সেখানে প্লাস্টিক আর পলিথিন প্যাকের আবর্জনা যেন জমে না থাকে।’

অঘোরচন্দ্র লজ্জিত হলেন। মুখে বললেন, ‘শুধু এইটুকুই?’

‘হ্যাঁ, মহারাজ। শুধু এইটুকুই। আপনি চাইলেই শুভ বিবাহের পূর্বে এই কাজটুকু করে ফেলা সম্ভব।’

‘অবশ্যই। যাকে ঘরের লক্ষ্মী করে আনছি, তার মনে যাতে কোনও খেদ না থাকে, সেটা তো দেখতেই হবে।’ অঘোরচন্দ্র হাঁক পাড়লেন, ‘ওরে কে আছিস মন্ত্রীকে এখনই এক বার ডাক। কাল থেকেই জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটা কাজ শুরু করতে হবে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন