রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

...

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১৫
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

বক্সারের যুদ্ধ শেষ। লখনউ নবাবের দরবারে ইংরেজ রেসিডেন্ট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে খবরদারি করার জন্যে। নবাব আসফ উদ দৌলার হাতে অঢেল সময়— এই পরিস্থিতিতে যে কোনও লোক তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত বরিশালের গল্পের চরিত্রের মতো ভাবতে বসে— কী করুম! আর একটা নিকাহ্ করুম না চাচার লগে মামলা করুম! নবাব সেই পথে পা না বাড়িয়ে স্থাপত্যকীর্তির দিকে মন দিলেন—ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা সুনিশ্চিত করতে। রুমি দরওয়াজা বানানোর পর যখন নিশ্চয় ভাবছিলেন— দরজা হল, বাড়ি কই? এমন সময় লখনউয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হল। প্রজারা নবাবের কাছে দু’মুঠো খেয়ে বাঁচার জন্যে আবেদন জানাল। নবাবের মাথায় এল এক অসাধারণ পরিকল্পনা। তিনি ঘোষণা করলেন, শ্রমের বিনিময়ে খাবার মিলবে। প্রজারা এক ইমারত তৈরি করবে, আর বিনিময়ে খাবার পাবে। বিশাল বড় বড় হাঁড়িতে চাল, মাংস, মশলা, ঘি, কন্দ একসঙ্গে দিয়ে কাঠের আগুনের আঁচে চড়িয়ে দেওয়া হল, আর হাঁড়ির মুখ ময়দার লেই দিয়ে আটকে দেওয়া হল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রজারা এসে খেয়ে যেতে লাগল। এই রান্নার খুশবু এক দিন রাজপ্রাসাদেও পৌঁছল আর এই রান্না রাজার রসুইখানায় নিজের স্থান করে নিল। এই ভাবেই জন্ম হল কালজয়ী দমপখ্ত রান্নাশৈলী, যা অওধি বিবিয়ানিকে এত বিখ্যাত করেছে বিশ্বের দরবারে।

বিরিয়ানি নিয়ে আগে একটা লেখায় বলেছি, এই খাবার নবাব আর সেনাদলের হাত ধরে দেশের বিভিন্ন কোনায় পৌঁছেছে— আর সেখানকার স্থানীয় খানা-ঘরানার সংস্পর্শে এসে কিছুটা করে বদলে গিয়েছে। যখন আসফ জাহি বংশের কামারুদ্দিন সিদ্দিকি মুঘল সম্রাটের কাছে দাক্ষিণাত্য শাসনের দায়িত্ব পান, বিরিয়ানি মুঘল দরবার থেকে হায়দরাবাদ পৌঁছয়। হায়দরাবাদি বিরিয়ানিতে মশলার আধিক্য আর একাধিক ছোট মাংসের টুকরো— উত্তর ভারতের বিরিয়ানির সঙ্গে এক্কেবারেই মেলে না। মেমনি বিরিয়ানি ভীষণ মশলাদার, সিন্ধি বিরিয়ানিতে কাঁচা লংকার আধিক্য থাকে। তাহিরি বিরিয়ানি হচ্ছে নিরামিষাশীদের জন্যে— সবজি আর আলু দিয়ে তৈরি।

Advertisement

নিরামিষাশীরা যখন বিরিয়ানি-মুখী, তা হলে যে ভারতীয় খাবারের অনুপ্রেরণায় বিরিয়ানি তৈরি হয়েছিল বলে শোনা যায়, সেই খিচুড়ি কি সময়ের প্রকোপে হারিয়ে গেল? এক্কেবারেই না। মুঘল বাদশারা এক দিকে বিরিয়ানির খুশবু দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিয়েছেন, অন্য দিকে নিজেদের হেঁশেলে খিচুড়িকেও দস্তরখানে জায়গা দিয়েছেন। সম্রাট আকবরের রসুইঘরে খিচুড়ি রান্না হত সমান পরিমাণ চাল, মুগ ডাল আর ঘি দিয়ে। জাহাঙ্গিরের যে দিন আমিষ খাবারে মন লাগত না, সে দিন তাঁর পছন্দের খাবার ছিল লাজিজান নামে এক পেস্তা-বাদাম দেওয়া মশলাদার গুজরাতি খিচুড়ি। আর খিচুড়ি ভারতবাসীর এত প্রিয়, এটা শুধু তারা নিজেরা খেত না, নিজের ঘোড়াকেও খাওয়াত পুষ্টি আর শক্তির জন্যে। ১৪৭০ সালে লেখা রুশ পর্যটক আকানাসি নিখিতিন-এর ভারতবর্ষের অভিজ্ঞতা তাই বলে। বিরিয়ানি যখন দেশজয়ে বেরিয়েছে, খিচুড়ি নিঃশব্দে ইংল্যান্ড জয় করে ফেলেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দৌলতে। সাহেবদের প্রাতরাশের টেবিলে আজও পরিবেশিত কেডগেরি আমাদের খিচুড়িরই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের দেওয়া নাম।

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি দমপখ্ত-এর বিরিয়ানি খেয়ে লখনউয়ের প্রজারা কী তৈরি করেছিল? বড়া ইমামবাড়া!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

চোখে দেখা প্রথম কবি হচ্ছেন দিগম্বরদা। এর আগে কবি দেখেছি মানেবইতে। রবীন্দ্রনাথকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি দেওয়ালে, গানের ইস্কুলের সাইনবোর্ডে, ধূপকাঠির প্যাকেটেও। কিন্তু অন্যান্য কবিদের ছবি মানেবইতেই। ব্যাখ্যা মুখস্থ করতাম ‘আলোচ্য ছত্র দুটি কবিবর অমুক চন্দ্র অমুকের অমর সৃষ্টি তমুক কবিতা হইতে গৃহীত হইয়াছে। কবি বলিতেছেন...।’

নাটকেও কবি দেখতাম, হাতে ধরা ফুলেল কোঁচা, বাবরি চুল, সুরেলা গলা। কিন্তু জ্যান্ত কবি দিগম্বরদাকে দেখে পুরনো ধারণা ভেঙে গেল। পাজামা, নোংরা খদ্দরের পাঞ্জাবি, মুখে খোঁচা দাড়ি, আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট, উদাস চাউনি, একা ঘুরছেন গঙ্গার ধারে। ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন এক দিন— সারা দিন লসাগু গসাগু করে ক্লান্ত তুই, লাল স্কুল ড্রেস, খুলে নে, খুলে নে, স্নান কর, ফ্রেশ হ, কাল তো আবার সেই থোড়-বড়ি-খাড়া...। মনে ভাবি, কী অসাধারণ। চিন্তা করি, যদি ব্যাখ্যা করতে হয়, তা হলে লিখব— কবি সূর্যকে এক স্কুল-পড়ুয়ার সহিত তুলনা করিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন...

আমাদের পাড়ায় নতুন এসেছিলেন দিগম্বরদা। আট নম্বর বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতেন, মা ও ছেলে। দিগম্বরদার মা আর জি কর হাসপাতালে আয়ার কাজ করতেন।

সরস্বতী পুজোর পর স্টেজ বেঁধে ছোটখাটো ফাংশন করতাম আমরা। দিগম্বরদা বললেন, স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন। আমাদের ফাংশন সেক্রেটারি কাম ফাংশন অ্যারেঞ্জার কাম ঘোষক পলুদাকে বললেন, আমার নাম যখন ঘোষণা করবে, দিগম্বর গুঁই না বলে অম্বর গুহ বলবে। তাই হল। উনি এক গুচ্ছ কবিতা পড়লেন, যার ব্যাখ্যা-সারমর্ম-ভাব সম্প্রসারণ কিছুই করতে পারার সাধ্য ছিল না আমাদের। বুঝলাম, এগুলো আধুনিক কবিতা। একটা কবিতার দুটো লাইন আজও মনে আছে। ‘এখানে উৎসব হচ্ছে, মঙ্গল ঘট। সমবেত শত ছানাপোনা। উৎসব ক্ষেত্র জুড়ে আঁকা আছে গুয়ের আলপনা।’ খুব উদাত্ত গলায় পড়েছিলেন। পরে বুঝেছি, ওটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্টাইল। দিগম্বরদার প্ররোচনায় দেওয়াল পত্রিকা বের হল পাড়ায়, কিছু দিন পর হাতে-লেখা পত্রিকাও। প্রধান উপদেষ্টা ‘অম্বর গুহ’।

ভাব হয়ে গেল। মাঝে মাঝে হাংরি কবিদের কবিতা পড়ে শোনাতেন, তুষার রায়ের কবিতাও। ঝোলা থেকে দু-চারটে চটি পত্রিকা বের করতেন। দ্যাখ, আমার কবিতা বেরিয়েছে। দেখতাম ছাপার অক্ষরে লেখা দিগম্বর গুঁই। কিছু দিন পর দিগম্বর গুঁই নয়, অম্বর গুহ। জানতে চাইলাম, মা-বাবার দেওয়া নামটা পালটালেন কেন? পদবিও! উনি বললেন— এই নামে ‘দেশ’ পত্রিকা ছাপে না। দিগম্বর গুঁই দেখলেই ফেলে দেয়। এ বার ছাপবে। কী আর এমন নাম পালটেছি! দিগম্বরের অম্বর তো রইলই, গুঁই-এর রস্যিকারের টিক্কিটা উড়িয়ে দিয়েছি শুধু। সেই আমিই তো রইলাম। শব্দ বড় মায়াময়। একটু অদলবদল করলেই ম্যাজিক হয়ে যায়। আর আমি কী এমন চেঞ্জ করেছি? কবি হারাধন খাঁড়া কেমন দেবী রায় হয়ে গেল। অম্বর নামটা ভাল না বেশ? বলি, ভাল তো। অম্বর রায় রঞ্জিতে সেঞ্চুরি করেছে। দিগম্বরদা বললেন, ক্রিকেটের সঙ্গে মেলাস না গবেট।

না, অম্বর গুহ হয়েও ‘দেশ’-এ কবিতা হল না। এক দিন বললেন, কবিতার উপর অভিমানী হয়েছি আমি। কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি। এ বার গদ্যের দিন। গদ্যই লিখব।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

গল্প ছাপা হচ্ছিল। ব্যাগ থেকে মলাট দেওয়া বই বের করে সূচিপত্র দেখাতেন দিগম্বরদা। গল্প: সুলতা বউদি। অম্বর গুহ। দুপুরবেলা। অম্বর গুহ। অম্বর গুহ নামটার তলায় তলায় কালির দাগ থাকত। গল্পটা দেখাতেন না। দেখতে চাইলে বলতেন— এখনও এ সব গল্প বোঝার সময় হয়নি তোর। আরও বড় হ।

বড় হতে লাগলাম। নাকের তলায় গোঁপের রেখা দেখা দিল, গোয়েন্দা রিপ আর ডায়না ছেড়ে হলুদ মলাট বই। সেই সব বইয়ের নাম ছিল পুষ্পধনু, প্রজাপতি, জীবন যৌবন...। এক দিন ও রকম একটা বইয়ের মধ্যে দেখি অম্বর গুহর গল্প।

তত দিনে দিগম্বরদার সঙ্গে যোগাযোগ কমে এসেছিল। দিগম্বরদা কোথাও ছোটখাটো কাজও জুটিয়েছিল বোধহয়। মাঝে মাঝেই টলতে টলতে রাস্তায় হাঁটতে দেখতাম। আরও রোগা হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করতাম, লেখালিখি চলছে তো? ঘাড় অনেকটা কাত করে বলতেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, ওটা কি ছাড়া যায়? ওর মা বলতেন— কী যে ছাই সাহিত্য করে ছেলেটা, সাহিত্যই ওকে শেষ করল।

দিগম্বরদার অসুখ হল। হলুদ হয়ে গেল শরীর। পেট ফুলে গেল। আর জি কর হাসপাতাল থেকে ডেড-বডি এল এক দিন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আমিও শ্মশানে গেলাম। ওর মা যাননি। একটা চটের থলেতে খবরকাগজে মোড়া দুটো বড় বড় প্যাকেট ভরে দিয়ে বললেন— এ সব ওর সঙ্গে দিয়ে দিও। তখনও ইলেকট্রিক চুল্লি হয়নি। কাঠ। জ্বলন্ত কাঠের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম ওর জীবনজোড়া গদ্য-সাহিত্য। আগুন জ্বলছিল। শুনছিলাম ‘বিদায় বন্ধুগণ, গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখার রুমালনাড়া নিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কিনা’।

swapnoc@rediffmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন