পিনাকী ভট্টাচার্য
হালুয়া যদিও বাইরে থেকে এ দেশে এসেছে, বাঙালির হালুয়া-ভক্তি বিস্ময়কর। এমনকী পুজোর ভোগেও হালুয়া বিরাজমান। আমার চেনা এক জন তো ছোটবেলায় চিরতার জলে করা হালুয়াও সোনামুখে খেয়ে নিয়েছিল!
আজকের হালুয়ার বয়স প্রায় হাজার বছর। পশ্চিম এশিয়ার পণ্ডিতেরা বলেন, ইজরায়েলের কাছে বাইজান্টিয়াম-এ হালুয়ার জন্ম একাদশ শতাব্দীতে। যদিও চিনি, ময়দা আর তেল দিয়ে তৈরি হালুয়া জাতের ডিজার্ট পাঁচ হাজার বছর ধরে শেষ পাতে পরিবেশিত হচ্ছে। হালুয়ার রেসিপি প্রথম পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা কিতাব-অল-তাবিখ বইয়ে— সেখানে সাত রকমের হালুয়ার বর্ণনা রয়েছে তার রন্ধনশৈলী সমেত। প্রায় একই সময় স্প্যানিশ ভাষায় এক রান্নার বইয়ে এক হালুয়া জাতীয় মিষ্টির কথা লেখা আছে, যা চিনির রস, মধু, তিলের তেল দিয়ে তৈরি হত আর তাতে গোলাপজল, বাদাম আর পেস্তাগুঁড়ো ছড়িয়ে ত্রিভুজাকারে কেটে পরিবেশন করা হত। পশ্চিম এশিয়া থেকে হালুয়া ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। যে দেশে যা সহজপ্রাপ্য, তা মিশল সনাতনি হালুয়ায়, আর স্বাদে বদল আনল। মিশরে এই পদ তৈরি শুরু হল পেস্তা আর বাদাম দিয়ে। আর ভারতবর্ষে হালুয়ায় মেশানো হল ঘি, নারকেল আর খেজুর।
অটোমান রাজত্বে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে রাজা ছিলেন সুলেমান (১৫২০-১৫৬৬)। তাঁর হালুয়া-প্রীতি প্রায় লোককথায় পরিণত হয়েছিল। তিনি তাঁর প্রাসাদের পাশেই তৈরি করেছিলেন এক বিশেষ রসুইখানা, শুধু হালুয়া বানানোর জন্য। রসুইখানার নাম দিয়েছিলেন হালভাহানে— যার আক্ষরিক মানে ‘হালুয়াদের বাড়ি’। তিরিশ রকম হালুয়া বানানো হত সেখানে। তারই মধ্যে থেকে তিল তেলে তৈরি এক হালুয়ার শৈলী অটোমান শাসিত রোমানদের হাত ঘুরে পৌঁছেছিল ইউরোপের আস্কেনাঝি ইহুদিদের হাতে, আর সেখান থেকে পরে আমেরিকায়।
ভারতে ঠিক কবে হালুয়া পৌঁছেছিল তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তবে প্রচলিত মত: হুমায়ুন বাদশা পারস্য দেশ থেকে নির্বাসন শেষে যখন ফেরত আসেন, সঙ্গে করে আনেন হালুয়া। আর তার সঙ্গে হালুয়া বানানোর কায়দা-কিসিম জানা লোকজন। এই হালুয়া এমন প্রবল ভাবে এ দেশের সনাতন মিষ্টান্ন-কুলকে নাড়া দিল, অচিরেই মিষ্টি-প্রস্তুতকারকদের প্রচলিত নাম হয়ে গেল হালোয়াই বা হালুইকর— সে হালুয়া বানাক আর না-ই বানাক। কিন্তু হালুইকরদের দোকানে পুরির সঙ্গে খাওয়ার জন্য যে সপসপে হালুয়া পাওয়া যেতে লাগল, তা কিন্তু আরব দেশ থেকে আসা হালুয়া নয়— সেটা হিন্দু মিষ্টি মোহনভোগের নামান্তর মাত্র।
হুমায়ুন সঙ্গে যে হালুয়া নিয়ে এসেছিলেন, তা আদপে এখনকার সোহন হালুয়া— আবদুল হলিম শরর-এর মতে তার চারটে উপজাতি— পাপড়ি, যূষি, হাবশি আর দুধিয়া। এই চার রকম হালুয়াই নির্ভেজাল মুসলমান মিঠাই, যার আদি দেশ পশ্চিম এশিয়া। আর তা বানানো আর হজম করা, দুটোতেই আলাদা এলেম লাগত। পাপড়ি হালুয়া সোহন-এর কিংবদন্তি শিল্পী মুনশি হাদি আলি এক সের সুজিতে ত্রিশ সের ঘি মাখতেন, আর প্রতি টুকরোয় আশ্চর্য সব নকশা তৈরি করতেন। আর এক বিখ্যাত হালুয়াশিল্পী মুনশি উস্সুলতান বাহাদুর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ্-র সঙ্গে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে নোঙর ফেলেন। তিনি পাপড়ি হালুয়া সোহন বানাতেন এক সের সুজিতে চল্লিশ সের ঘি দিয়ে।
বোঝাই যাচ্ছে, লে-লে-লে হালুয়া খা শুনে হালুয়া খেতে বসে যাওয়া যেত না সেই জমানায়, দস্তুরমত শারীরিক আর মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তবেই খানদানি হালুয়ার থালা আক্রমণ করা হত!
pinakee.bhattacharya@gmail.com