রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

.....

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ২০:৪৮
Share:

Advertisement

সুদর্শন নন্দী, রাইট টাউন, জব্বলপুর

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

গাঁয়ের ধারে মস্ত উঁচু ওই যে ব্রিজটা, ওর নীচে পাওয়া গিয়েছিল ইয়ানকে। আট-ন’বছরের বাচ্চাটা উপুড় হয়ে পড়েছিল। ব্রিজের মাথা থেকে ইয়ানের লাশটা প্রথম চোখে পড়েছিল এরিকের। এরিক, টমির দাদা। বয়স চোদ্দো। টমি ইয়ানের বন্ধু। বয়স ওই নয়টয়ই হবে! ওই ঘটনাটা ঘটার ক’দিন আগেই তো টমি আর অন্য একটা বন্ধুর সঙ্গে ওর বাবার পিস্তলটা নিয়ে ইয়ানের ঝগড়া হয়েছিল। ইয়ানই তো বন্দুকটা বাড়ির ভেতর থেকে নিয়ে এসেছিল। ওতে নাকি গুলি ভরা ছিল। ইয়ানের বাবা খুব বকেছিল সব্বাইকে! কিন্তু ইয়ানের ছোট্ট শরীরটা ব্রিজের নীচে অমন উপুড় হয়ে শুয়েছিল কেন? পড়ে গিয়েছিল? নিজেই লাফ দিয়েছিল? না অন্য কোনও রহস্যময় ব্যাপার? যে কোনও পরিচালকই ওই জায়গা থেকে ছবিটাকে থ্রিলারের মতোই ছমছমে, সাসপেন্স-মুখর করে তুলবেন। ওই বিশাল, পুরনো ব্রিজটা, ভোরবেলা বা সন্ধের আবছা অন্ধকারে যেটাকে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো দেখায়, কিংবা ওই ব্রিজের নীচের টানেলটা, ছোট্ট একটা ম্যানহোলের মতো ফুটো গলে যেখানে নেমে যাওয়া যায়, কিংবা গ্রামের সীমানায় ওই পোড়ো বাড়ি বা ওই জঙ্গলটা, যেখানে ভালুকও আছে সব মিলিয়ে-জুড়ে জমাট করেই বোনা যেত রহস্যের ঘনঘটা!

কিন্তু তাঁর প্রথম ছবিতে পরিচালক সে সবের ধারকাছ দিয়েও যাননি! এমনকী তিনি নিপাট-নিভাঁজ-নিটোল কোনও ন্যারেটিভও বানাতে চাননি। ছবি জুড়ে শুধু অজস্র মুহূর্তের মিছিল। সেই মুহূর্তগুলো গেঁথে গেঁথেই আলগা এক আখ্যানের মতো গড়ে ওঠে ছবির শরীর। কিশোরী মেয়ের ত্বকের মতো অনাবিল, আতুসি, লাজুক এক গ্রাম, মানিনী যুবতীর চোখের মতো যার আকাশ ছেয়ে ভারী হয়ে আসে মেঘ, আকুল বৃষ্টিতে ভেসে যায় বন, পাহাড়, হ্রদ, কবরখানা। সেই নির্লিপ্ত-সুখী, উদাসীন-নিশ্চিন্ত গ্রামটায় পরিচালক আস্তে আস্তে ঘনিয়ে আনেন এক আশ্চর্য মৃত্যুচেতনা! তবে সেই অনুভব কোনও শিরশিরে আতঙ্কের মতো শিরদাঁড়া বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এরিক আর টমি, আর তাদের বন্ধুরা তাদের রোজকার গুলতানি, হুল্লোড়, টইটই করে বেড়ানোর রুটিনের ফাঁকে-ফোকরেই মৃত্যুকে চিনছিল একটু একটু করে। রোদ-ঝলমল জীবনের উলটো দিকে মরা পাখি, থ্যাঁতলানো বেজি বা একেবারে প্রথম দৃশ্যে জলের মধ্যে সাপের মুখে জ্যান্ত মাছের ছটফটানির মতো সেই মৃত্যুতে অসহায়তা আছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার কষ্ট আছে, আচমকা সব থেমে যাওয়ার একটা ধাক্কা, শূন্যতা আছে।

বয়ঃসন্ধির এ পাশে-ও পাশে থাকা গ্রাম্য ছেলের দল সেটা যে খুব বুঝতে পারত এমনও নয়। লেকের জলে নৌকোয় ভাসতে ভাসতে এরিকের বন্ধু ট্রিজান যখন বলে, খুব মন-খারাপ হলে তার মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে, সেটা ছেলেমানুষিই থাকে। কিন্তু ইয়ানের ও ভাবে মরে যাওয়াটা তাদের ভেতরে ভেতরে খুব ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। তাদের নিঝুম, ছবির মতো গ্রামটা, যার রাস্তায় একটাও মোটরগাড়ি দেখা যায় না, তারও অন্দরে কোথাও একটা ভাঙচুর চলতে থাকে। মাঠের মধ্যে ছেলেদের খেলাচ্ছলে মারামারি আচমকাই ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে। ইয়ানদের বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনা পিস্তলটা এরিক ট্রিজানের কপালে তাক করে। সেই অসহায়, অসহ্য, না-বোঝা রাগেই হয়তো সে রাত-দুপুরে ইয়ানদের ফাঁকা বাড়িতে তুমুল তাণ্ডব করে। আবার এক ভোররাতে টমিকে নিয়ে চলে যায় ওই ব্রিজের নীচে। যেখানে ইয়ানের জন্য সে রিবন আর ফুল দিয়ে একটা ভালবাসার শহিদ বেদি সাজিয়ে রেখেছে।

পুরো ছবিটায় ইয়ানের মৃত্যুর ওপর থেকে রহস্যের পরদা সরানোর কোনও চেষ্টাই করা হয়নি! গোটা ঘটনাটা ঠিক কোথায় বা কোন সময় ঘটেছে, সেটাও স্পষ্ট করা হয়নি! আর যে ছবি স্থান-কালের চিহ্ন ছাড়াই অনন্ত সময়ের ভেলায় ভাসে, সে ছবির গল্পও এক জায়গায় শুরু হয়ে, আর একটা জায়গায় শেষ হতে পারে না। শেষ দৃশ্যে তাই টমি আবার ওই ব্রিজের তলায়। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। টমি দু’পাশে দু’হাত ছড়িয়ে আদিম কালের বালকের মতোই শরীর ভরে সেই বৃষ্টি নেয়। অন্ধকার পরদায় যখন এন্ড-টাইট্ল, সাউন্ডট্র্যাকে তখনও বৃষ্টির শব্দ। অঝোর, অফুরান।

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement