রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

...

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০০:১২
Share:


পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

রিকশাওয়ালাটি ওর নাম বলেছিল আজাদ মুন্ডা। একটু অবাক হয়েছিলাম। মুন্ডাদের মধ্যে আজাদ নাম হয় না। এখানকার রিকশাওয়ালাদের মধ্যে তো আরও ব্যতিক্রম।

আমি তখন চাইবাসায়। ওখানে একটা ছোট বেতারকেন্দ্র আছে। চাইবাসাকে বিখ্যাত করেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর শ্বশুরালয়ে তিনি অনেক বার গিয়েছিলেন, সন্দীপন-সুনীলও। সুতরাং ওই বাড়ি আমাদের তীর্থস্থান। সেই তীর্থে যাওয়ার জন্য আজাদের রিকশায় উঠেছি, তখন চাইবাসায় একদম নতুন, জিজ্ঞাসা করলাম ভাইয়া, মহুয়া কঁহা মিলতা হ্যায়,মহুয়া? ও প্যাডেল থামিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে গলায় বেশ ঝাঁজ মাখিয়ে জিজ্ঞাসা করল: মতলব, মহুল কা দারু?

Advertisement

আমি দুরুদুরু বুকে, লাজ লাজ মুখে বলি, হ্যাঁ, হ্যাঁ। লোকটা ও রকমই ঝাঁজালো গলায় বলল, মহুল কাঁহা মিলতা হ্যায় মালুম হ্যায় মুঝে, লেকিন বাতায়গা নেহি।

এমন রিকশাওয়ালা আগে কোনও দিন দেখিনি যে দারুঠেক কোথায় আছে জানে, অথচ বলে না।

জেনেছিলাম মধুটোলায় ছিল সমীরবাবুর শ্বশুরবাড়ি। মধুটোলায় গেলাম, হদিশ পেলাম না। তীর্থদর্শন হল না। ফেরার সময় চা খাব, চায়ের দোকানের পাশে পেঁয়াজি ভাজছিল, আজাদকেও গরম পেঁয়াজি দিতে চাইলাম, ও নিল না। বলল পেঁয়াজ-রসুন খায় না। এ কেমন আদিবাসী? যেন হরিদ্বারের বামুন। ওকে ভাল করে দেখি। একটা ধুতি পরে আছে, গেঞ্জিও। দুটোই নোংরা। সর্বাঙ্গে দারিদ্র। দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করি, ও কোনও মতে ‘হাঁ’, ‘নেহি’ করে এড়িয়ে যায়।

আমাদের অফিসের কাছে একটা রিকশা স্ট্যান্ড আছে। ওকে ওখানে দেখি। একটু শীত পড়ে গিয়েছিল, তাই গায়ে একদা সাদা ছিল এমন একটা চাদর। গল্পগাছা করার চেষ্টা করি। জিজ্ঞাসা করি কোথায় থাকা হয়, একটা গ্রামের কথা বলল, শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম বুজুড়ি। মাটির তলা থেকে সারা বছর জল বের হয়, সেই জল নাকি হর বেমারি কা দাবাই। সেই জলটাই আবার দুঃখের কারণ। ওই জলে সব হজম হয়ে যায়, খুব খিদে পায়। খিদে পেলেই তো সমস্যা। শহরের জলে সেই সমস্যা নেই। শহরের হোটেলে ভোজন করে নেয়, ডাল-ভাত-সবজি। বিকেলে যদি একটা ঠান্ডা নিমকি ঠুসে নেয়, আর খিদে পায় না।

এক দিন আজাদ মুন্ডার গ্রামে গেলাম। পাহাড়ের তলায়। তিসি আর ভুট্টার খেত, তিরতিরে নদী। নদীর উৎস হল সেই মাটি ফুঁড়ে বের হওয়া জল। পাথর ছড়ানো গ্রাম। ভদ্রলোকরা যাকে বলে সিনিক বিউটি। খুব সুন্দর। দেখি গাঁয়ের সবাই সাদা জামা পরে আছে, লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরেছে কেউ, মেয়েরাও সাদা খোলের শাড়ি।

ক্রমশ জানতে পারলাম এটা বিরসাইয়তদের গ্রাম। বিরসাইয়ত মানে বিরসা মুন্ডার অনুগামী। বিরসা মুন্ডাকে আমরা যোদ্ধা বলেই জানি, কিন্তু বিরসাইয়তদের কাছে তিনি ধর্মগুরু। ওরা বিরসা ভগোয়ান বলেই জানে। বিরসা ওঁর অনুগামীদের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন বাইবেলের মোজেসের মতোই— টেন কমান্ডমেন্টস। এর মধ্যে ছিল প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার, হত্যা না করা, মদ্যপান বর্জন, সংযমী জীবন, সপ্তাহে এক দিন বিশ্রাম, পাপের জন্য অনুশোচনা ইত্যাদি। আসলে, বিরসার বাবা খ্রিস্টান ছিলেন, প্রথম যৌবনে কর্মসূত্রে হিন্দু ব্রাহ্মণের সংস্পর্শে এসেছিলেন, এ ছাড়া মুন্ডাদের নিজস্ব শরনা ধর্ম— এই তিনের মিশেলে একটা জীবনপ্রণালীর ছক তৈরি করেছিলেন বিরসা। মুন্ডারা এক দিন স্বাধীন হয়ে মুন্ডারাজ কায়েম করবে— এ কথাও বলেছিলেন। বুঝলাম ওই রিকশাওয়ালার নাম কেন ‘আজাদ’। ওর অন্য নাম ছিল, নিজেই নিজের নাম পালটেছে।

আজাদ বলেছিল বিরসা ভগোয়ান আবার আসবেন। এই মুন্ডা সমাজেই জন্ম নেবেন ফের। এমনও হতে পারে, আমাদের বুজুড়ি গ্রামেই তিনি জন্মাবেন— এ কথা বলেই আকাশে তাকিয়েছিল ও। বলল, এর আগে এক বার বিরসা ভগোয়ান এই ধরতিতে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন ‘গান্ধী বাবা’।

আমার এক জন বন্ধু এল। ওকে নিয়ে এক দিন যাই বুজুড়িতে। আজাদের রিকশাতেই যাই বুজুড়ি গ্রামে। বন্ধুটি মাঝরাস্তায় মহুয়া বের করেছিল ব্যাগ থেকে। চুমুক দিচ্ছিল। আজাদ ফিরে তাকাল। বলল, মত পিজিয়ে সাব।

গ্রাম দেখালাম বন্ধুকে, জলধারা, মহুয়াগাছ...। সিনিক বিউটি দেখালাম।

ফিরব, দেখি একটা পুরনো গাছের কোটরে মুখ রেখে আজাদ বিড়বিড় করছে।

ওটা ওদের কনফেশন ট্রি। পাপ স্বীকারের গাছ।

ওর রিকশায় মদ্যপান ঘটেছে, ক্ষমা চাইছে ও।

ও আমায় বলল— অধর্ম হয়েছে সাব। রিকশায় দারু পিয়া করা হয়েছে। মাঝপথে নামিয়ে দিলে আরও বেশি অধর্ম হত। যতটা পারি শুদ্ধ থাকি সাব। আমার স্ত্রীর এত দিন সন্তান হয়নি। এখন গর্ভবতী। কে জানে আমার ঘরেই বিরসা ভগোয়ান আসছেন কি না...

pinakee.bhattacharya@gmail.com


স্বপ্নময় চক্রবর্তী

প্রথম যৌবনের দিনগুলোয় বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে শেষ দিন সন্ধ্যায় আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে ফুর্তি করার সময় পৃথিবী রঙিন হয়ে উঠত। রঙের ফোয়ারা ছুটত, যখন আগুনের দু’পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে তাতে মাংসের টুকরো ঝুলিয়ে সেঁকার প্রবল চেষ্টা চলত। ক্ষিতিতে বসে তেজের সামনে অপ পেটে নিয়ে ব্যোম মাথায় মরুৎ-এর মাঝে চরম সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায় এই মাংস ঝলসে যেটা করা হত সেটা নাকি ছিল বারবিকিউ।

বারবিকিউ শুরু করেছিল ক্যারিবিয়ান আর বর্তমান ফ্লোরিডার তাইনো উপজাতি, যারা ১৮২১ সালে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল (হালে অবশ্য তাইনোদের বংশধরদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছে)। তাইনো ভাষায় বারবিকিউ কথার অর্থ ‘পবিত্র অগ্নিপিতার উৎসস্থান’—আর ‘তাইনো বারাবিকোয়া’র মানে ‘চারপেয়ে কাঠের দণ্ড আর অনেক কাঠের টুকরো মাংস রান্নার জন্য।’


ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সেই জমানায় আমেরিকার উত্তরাংশের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের ফারাক ছিল বিস্তর। উত্তরের সংস্কৃতির হাওয়া নীচের দিকে এসে পৌঁছয়নি। মেক্সিকো আর তার উত্তরাংশের আমেরিকা ছিল অনেক রুক্ষ। শুয়োরের মাংস ছিল সেখানকার প্রধান খাদ্য। কারণ বুনো শুয়োরের অভাব ছিল না— শুয়োরের শরীরের কোনও অংশই ফেলা যেত না। আর দেহের কিছু বিশেষ অংশ সংরক্ষণ করে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন শৌখিন খাবার বানানো হত। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের আগে এই অঞ্চলে মাংসের জোগান কম পড়লেই জঙ্গলে গিয়ে শুয়োর শিকার এক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছিল— সময়ের সঙ্গে তা এক উৎসব হয়ে ওঠে। আর সেই শিকার করা শুয়োর বারবিকিউ’তে রান্না করে খাওয়া হয়ে ওঠে এই উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে গৃহযুদ্ধের মাঝের সময়ে বারবিকিউ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্ল্যান্টেশন মালিকদের কিছু দিন অন্তর মস্ত বারবিকিউ করা এক রীতি হয়ে দাঁড়ায়। এই উৎসবে দাসদেরও পুরো বঞ্চিত করা হত না, তাদের জন্য তৈরি হত শুয়োরের মাংসের আচার— যাতে বেশি দিন ধরে খেতে পারে। গৃহযুদ্ধের আগে দক্ষিণ আমেরিকার মানুষরা শুয়োরচাষে মন দেয়, যাতে তাদের মাংস সরবরাহের জন্য উত্তর ভাগ আর শিকারের ওপর শুধু নির্ভর করে থাকতে না হয়। এই সময়ে বারবিকিউ শুধু খেত-খামারে সীমাবদ্ধ না থেকে চার্চ-পিকনিক আর ঘরোয়া পার্টিরও অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।

বারবিকিউ-এর উৎপত্তি নিয়ে আর একটা গল্প আছে। স্পেনের অধীনে থাকা হিস্পানিয়োলা নামে এক দ্বীপের প্রথম যুগের বাসিন্দারা জাহাজে করে প্রচুর গবাদি পশু এনেছিল। খোলা প্রকৃতিতে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটিয়ে এই গবাদি পশুদের সংখ্যা ফুলেফেঁপে উঠল। আর কিছু দিন বাদে এই দ্বীপ হয়ে উঠল ভাঙা জাহাজের নাবিক, পালিয়ে আসা ক্রীতদাস আর বিভিন্ন ভবঘুরের স্বর্গরাজ্য। কারণ এত বেওয়ারিশ গরু-শুয়োর থাকতে, না খেতে পাওয়ার কোনও ভয় ছিল না এখানে। তখনও বেঁচে থাকা কয়েক ঘর ক্যারিবিয়ানের কাছে আগুনে মাংস ঝলসে রান্নার কায়দা শিখে নিয়েছিল— যাকে ক্যারিবিয়ানরা বলত বোক্যান্আর তা করার কাঠের তৈরি কাঠামোকে বলত বার্বাকোয়া— যেটা পরবর্তী কালে বারবিকিউ হয়ে যায়। আর ‘বোক্যান্’ শব্দটি ঢুকে গেছে ফরাসি অভিধানে— যেখানে ‘বোক্যানের্’ শব্দের অর্থ ‘ব্রাত্য’— হিস্পানিয়োলা’তে আস্তানা করা মানুষদের মনে রেখে।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement