আমার কথা, শুধু আমার নিজের নয়। আমার প্রথম বই, তা-ও আমার একার নয়। আমাদের রেলস্টেশনে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল মানিকের সঙ্গে। অনেক বছর পর। দুজনেই দুজনকে চিনতে পারলাম। আমার প্রথম বই ১৯৭৭ সালের মার্চে যখন বের হয়, আমার বন্ধু এই মানিক আর তার সঙ্গীরা এক টাকা দামের বইটি ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি করেছিল। মানিক তখন ছিল ট্রেনের হকার। শ্রীরামপুরের সেকালের অতিখ্যাত বাসন্তী চানাচুর বিক্রি করত ওরা। সে বই ঘিরে তাদের উল্লাস সে সময়, যেন ও-বই তাদের নিজেদের।
সিসের হরফ খোপ থেকে তুলে তুলে পৃষ্ঠার আকারের ধাতব খণ্ডটি পাটের ফেঁসোয় বেঁধে, সেই ব্লকটি মেশিনে তুলে ছাপা হত সে সময়। লেটার প্রেস। সে সব প্রেস— নিউ রামকৃষ্ণ প্রেস, জোনাকি প্রেস, দীপঙ্কর প্রেস, বঙ্গরত্ন মেশিন প্রেস— আমাদের বইগুলি, তাদের। মুদ্রক রতিকান্ত নস্কর, শিবব্রত ভট্টাচার্য, দুর্লভ কোলে, কম্পোজিটর স্বপ্না চক্রবর্তী, কালীপদ চৌধুরী, ছবি মেট্যা, সদাশিব পোল্যে— আমার ও আমাদের বইগুলি, তাঁদেরও। তামাম বাংলার শত শত ছোট পত্রিকা, আমাদের বইগুলি, সেই সকলের।
বরাবর আমি কবিতাপ্রয়াসী মানুষ, সেই বাল্যকাল থেকে। শিশুকালে আমি আমার বাবার দুই ঠাকুমাকে দেখেছি। তাঁরা দুজনেই শতবর্ষ ছুঁইছুঁই, বা তা অতিক্রান্ত বয়স পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। সেই দুই বড়্ঠাকুমা ও আমার ঠাকুমা ফি-বছর আষাঢ় মাসে সুর করে পড়তেন বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল। ‘পশ্চিমে ঘাঘর নদী, পূর্বে ঘণ্টেশ্বর/ তারি মাঝে গেলা গ্রাম, বৈদ্যের নগর।’ আমি চুপটি করে শুনতাম আর দুলতাম। সে বই বাকি সারা বছর ঠাকুরঘরের তাকের ওপর পরম যত্নে সম্পদ হিসেবে রক্ষিত থাকত। আমার মা সম্ভবত তাঁর বিবাহের প্রথম বার্ষিকীটিতে জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইখানি উপহার পেয়েছিলেন। এই বইটিও রাখা থাকত ঠাকুরঘরের তাকের ওপর মনসামঙ্গলের পাশে। পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় ওই দুটি পবিত্র গ্রন্থ ঠাকুরঘর থেকে এনে যত্রতত্র আমি পাঠ্যবইয়ের মতো উচ্চস্বরে পাঠ করতাম। ক্রমে কৈশোরের বিবেচনায় কণ্ঠ খাদে নেমে আসে। ‘স্তন তার/ করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আর্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার;/ এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।’ এ সব কবিতা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মগ্ন দুপুরে, শীতল সন্ধ্যায় মা-কে আমি জিজ্ঞাসা করতাম, স্তন কী? আর্দ্র শব্দটির অর্থ কী? এ পৃথিবী কেনই বা এক বার পায় তাকে, আর কেন পায় না?
সে বয়সে আমার তরুণী জননী তেমন কিছু কাব্যবোদ্ধা ছিলেন না। তা সত্ত্বেও শব্দের অর্থ আমাকে বুঝিয়ে দিতেন। রূপকথার মতো করে শঙ্খিনীমালার বর্ণনা দিতেন, যার চোখ নীল, ব্যথাতুর। আমার মা স্বল্পশিক্ষিতা ছিলেন, দেশভাগে নবম-দশম শ্রেণিতেই তাঁর স্কুলশিক্ষায় ছেদ ঘটে। তথাপি প্রাপ্তবয়সে আমি যখনই তত্সম শব্দের অর্থে বা বানানে সংশয়াচ্ছন্ন হয়েছি, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে নির্ভুল নিশ্চয়তা পেয়েছি। বস্তুত আমার সঙ্গেই তিনি জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করেছেন। ওই সময় আমি ‘কবি ও কবিতা’, ‘উত্তরসূরি’, ‘লা পয়েজি’ ও ‘দেশ’ পত্রিকাগুলির কবিতা পড়তে শুরু করি। আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার মা-ও কবিতা-আসক্ত হয়ে পড়েন।
শ্রীরামপুরে আমার অগ্রজ কবিতাপ্রয়াসীরা সে সময় ‘শীর্ষবিন্দু’ নামে একটি ছোট পত্রিকা প্রকাশ করেন। ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আমার প্রথম কবিতা। শীর্ষবিন্দু আয়োজিত এক কবিসম্মেলনে এসে ধূর্জটি চন্দ আমার কবিতার খাতা থেকে সাতটি কবিতা ছিঁড়ে তাঁর ‘এবং’ পত্রিকার জন্য নিয়ে যান। শান্তনু দাশ তাঁর ‘গঙ্গোত্রী’ পত্রিকার জন্য নিয়ে যান একটি কবিতা। উত্তরপাড়ার এক কবিসম্মেলনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় কৃত্তিবাসের জন্য কবিতা নিয়ে নেন। তারাপদ রায় নিয়ে নেন ‘কয়েকজন’ পত্রিকার জন্য কবিতা। ওই সময় আমি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র।
‘এবং’ পত্রিকায় কবিতাগুলি প্রকাশের সময় ধূর্জটি চন্দ আমার সম্পর্কে উল্লাসে দু-চার কথা লিখে দেন, এতে পুলকিত হয়েছিলাম, ঈষত্ লজ্জিতও। এর পর কবিতা সিংহ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিতব্য সত্তর দশকের প্রথম কবিতা সংকলন ‘সপ্তদশ অশ্বারোহী’র জন্য কবিতা চেয়ে আমাকে চিঠি দেন।
১৯৬৯, ’৭০, ’৭১ সালগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার নেই। উভয় বাংলা তখন ছিল মুক্তি ও বিপ্লববাসনায় নৃত্যরত। সময় তখন দুলছিল। কবিতা ক্ষেত্রে আমরা সেই নৃত্যরত সময়ের জাতক।
আমি বিশ্বাস করি কবিতা আকাশ থেকে নামে। কবিতা-রচনা প্রথাবিরুদ্ধ কাজ। সমাজদেহে কবিরা লুক্কায়িত। নিজেকে আমি মনে করি লাল কার্পেটের নীচে লুকিয়ে থাকা আলপিন। বিছানায় ছুঁচ। বরাবর আমি কবিতা লেখার নাছোড় চেষ্টা চালিয়ে গেছি। সে বড় কঠিন কাজ। এ সব সত্ত্বেও আমার প্রথম বইটি কিন্তু কবিতার বই নয়। সে বই গল্পের। তিনটি গল্প। বড় আকস্মিক ভাবে বের হয় সে বই।
শেওড়াফুলি থেকে সে সময় আমার দুই বন্ধু শ্যাম ভাওয়াল আর শ্যামলেন্দু বিশ্বাস বের করত ‘সংবর্ত’ পত্রিকা। একটি সংখ্যা ছাপতে গিয়ে তিনটি পাতায় কোনও লেখা না থাকায়, ওরা ধরল একটি গল্প লিখে দেওয়ার জন্য। ঝপ করে মাঝরাত্তিরে বসে পড়লাম চিলেকোঠায়। তত্কালে এক সিগারেট বাজারে এসেছিল, ‘পার্সোনাল প্রেফারেন্স’, সংক্ষেপে পিপি। স্বকল্পিত প্রেমিকার নাম দিয়ে দিলাম পিপি। কখনও পিপি গিলে ফেলছে তাঁর প্রেমিককে, কখনও প্রেমিক খেয়ে ফেলছে পিপিকে। উভয়ের অনুশোচনাতেই এই গল্প সংবর্ত-র তিনটি পৃষ্ঠা ভরিয়ে দিল।
এর পর দু’মাসে আরও দুটো গল্প লিখে ফেললাম পিপিকে নিয়ে। শ্যামলেন্দু বলল, একটা বই হয়ে যাক। শ্রীরামপুরের বেলা প্রেসের নরোত্তম সেন ছেপে দিলেন সে বই, ‘আমি আর পিপি’। এক টাকা দামের এই বই বের হল ১৯৭৭ সালের মার্চে। মানিকরা ট্রেনে ট্রেনে বেচল, বন্ধুদের বিলি করলাম। দু’পয়সার বুকপোস্টেও পাঠানো হল অনেককে। প্রচ্ছদ লিনোকাটে আমিই তৈরি করেছিলাম। শৌনক লাহিড়ী ‘আঁতু’ পত্রিকায় চমত্কার একটা আলোচনাও লিখল। যেন আদর করল।
বছর খানেক পর মনে হল, কাজটা ঠিক হল না। খামখা কেন গল্প লিখতে গেলাম! বইটা গোপন করতে থাকলাম। বইটা সম্পর্কে চুপচাপ হয়ে গেলাম। আমার কাছে যে কপিগুলি ছিল, পুরনো খবরের কাগজের স্তূপের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। যাতে বাড়ির লোক ওজন করে বিক্রি করে দেয়।
নিজের বইগুলিকে আমি আমার পুত্রকন্যা ভাবি। আমার মেয়ে ঘ্যাংঘুং-এর বড় এক দিদি আছে। তার নাম ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তারও আবার বড় এক দাদা আছে। তার নাম ‘আমি আর পিপি’। সে বুনো, জঙ্গলে থুম মেরে বসে আছে সে। আমিই তাকে গহীন অরণ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি।
mridul_dasgupta@yahoo.co.in