অনুরাধা সব সময়ে সব বিষয়ে সেরা নম্বর পায়। শুধুমাত্র একটা বিষয় ছাড়া। সেটা হল অঙ্ক। অঙ্কে যে ও কাঁচা, তা কিন্তু নয়। আসলে খুব ছটফটে স্বভাবের বলে অঙ্ক কষতে প্রায়ই ছোটখাটো ভুল করে বসে। যেমন, অঙ্কটা টুকতেই হয়তো ভুল করে ফেলল, যোগের জায়গায় বিয়োগ, বা ভাগের জায়গায় গুন লিখে ফেলল। ব্যস, অঙ্ক গেল কেঁচে। কখনও সংখ্যাগুলোও তাড়াহুড়োয় ভুল লিখে ফেলে। আর অঙ্ক তো সামান্য ভুল হলেই পুরোটা ভুল হয়ে যায়। এ সব কারণে আশি নম্বরের বেশি অঙ্কে কখনও পায়নি অনুরাধা। আর এখানেই ওকে বরাবর টপকে যায় বাসুদেব। অঙ্কের সর্বোচ্চ নম্বরটা বাসুদেবের দখলেই থেকে যায়।
বাসুদেব অন্য সেকশনে পড়ে। খুব শান্ত আর পড়াশোনায় ভীষণ মনোযোগী। অনুরাধা পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেলে বাসুদেবের হয় দ্বিতীয় স্থান। কখনও এর উল্টোটাও হয়। ওদের ক্লাসের মোট চারটে সেকশন। চারটে সেকশনের মধ্যে প্রথম দুটো স্থান ওরাই সব সময় ভাগাভাগি করে নেয়।
অনুরাধা যে খুব প্রতিযোগী মনের, তা কিন্তু নয়। এ ব্যাপারে ও বাসুদেবের একেবারে উল্টোটা। বাসুদেব ধীর স্থির ছেলে। সারা দিন পড়াশোনা নিয়েই থাকে। সেরা রেজাল্ট করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। অনুরাধার মতো বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করে, আড্ডা মেরে বা মিছেমিছি খেলাধূলা করে সময়ের অপচয় করে না। অন্য দিকে, অনুরাধা যেমন পড়ে, যেমন পারে, যেমন বোঝে, পরীক্ষাতে তেমনটাই লিখে আসে। পড়ার বইয়ের চাইতে ও গল্পের বই আর অন্যান্য নানান বিষয়ের বই পড়ে বেশি। পড়াশোনার চাইতে ছবি আঁকতে আর কবিতা লিখতে বেশি ভাল লাগে অনুরাধার।
ছবি: দেবাশীষ দেব
পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও অনুরাধার তেমন মাথাব্যথা হয় না। প্রথম হলে খুশি হয়; কিন্তু দ্বিতীয় হলেও তেমন দুঃখ হয় না। ওর শুধু একটা ব্যাপারেই দুঃখ। অঙ্কের মতো সহজ বিষয়টাতে ও এক বারও সেরা নম্বর পেল না। অথচ অঙ্ক ওর ভালই লাগে, সহজে বোঝে, মোটেই কঠিন মনে হয় না। তবু যে কেন ছোটখাটো ভুল করে ফেলে পরীক্ষার খাতায়, ও নিজেই বুঝতে পারে না। ওর মায়ের অভিযোগ, বাড়িতে অঙ্ক একেবারেই অভ্যাস করে না ও। এ কথা মিথ্যেও নয়। স্কুলে মাস্টারমশাইরা যতটুকু অঙ্ক করান, অনুরাধার ততটুকুই অঙ্ক কষা হয়। আসলে স্কুলেই শেখা হয়ে যায় বলে বাড়িতে করার তাগিদ থাকে না ওর। কিন্তু অঙ্ক যে কেবল নিয়ম শিখলেই হয় না, অভ্যাসও করতে হয়, সে কথা ও বোঝে না। পড়তে বসেও উড়ু উড়ু মন নিয়ে নানা রকম আজব স্বপ্ন-দেশে ভেসে বেড়ায়। কখনও হোমওয়ার্ক করার খাতায় কবিতা লিখতে শুরু করে দেয়। যে জিনিসটা বাড়িতে না পড়লেই নয়, সেটাই বাড়িতে ও পড়ে নেয়। বাকিটা স্কুলে দিদিমণি, মাস্টারমশাইদের বোঝানো থেকেই শিখে ফেলে।
অঙ্কের মাস্টারমশাইও মাঝে মাঝে আপশোস করেন। বলেন, ‘নিয়ম পদ্ধতি সব ঠিক করেও ছোটখাটো ভুল করে অঙ্কগুলোর সর্বনাশ করিস। তুই বড্ড চঞ্চল অনুরাধা।’ মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে অনুরাধার খারাপ লাগে বটে। ও তখন মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে, এখন থেকে মন দিয়ে এবং সতর্ক হয়ে অঙ্ক করবে, যাতে একটাও ভুল না হয়। কিন্তু পরীক্ষার সময় সে সব প্রতীজ্ঞার কথা বেমালুম ভুলে যায়।
তবে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষাতে হিসেব গেল উল্টে। পরীক্ষার ফল জানানোর পরে উত্তরপত্রগুলো প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের দেখতে দেওয়ার নিয়ম। যে দিন অঙ্কের উত্তরপত্র দেওয়া হল, অনুরাধা দেখল, ও এ বার বিরাশি পেয়েছে। মাস্টারমশাই জানালেন, এ বারে এটাই সর্বোচ্চ নম্বর। অঙ্কে একশোতে বিরাশি নম্বর মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। অনুরাধা অন্যান্য বিষয়ে সব সময় আশির ওপরে নম্বর পায়। কিন্তু এ বারের ব্যাপার আলাদা। প্রথমত, এই প্রথম ও অঙ্কে আশির ঘর পেরোল। দ্বিতীয়ত, এই প্রথম ও অঙ্কে সর্বোচ্চ নম্বর পেল। ফলে আনন্দে খুশিতে অনুরাধা উচ্ছ্বসিত। মাস্টারমশাই বললেন, ‘এ বারে ভুল কম করেছিস ঠিকই, কিন্তু আরও ভাল করতে হবে।’
উত্তরপত্র হাতে পেয়ে সবাই নিজেরটা উল্টে পাল্টে দেখছে। কোথায় কী ভুল হল, ভুলটা কেন হল? তা ছাড়া প্রতিটা উত্তরের পাশে শিক্ষকদের দেওয়া নম্বরগুলোও সবাই গুনে গুনে যোগ করে দেখে নেয়, ঠিক আছে কি না। অনেক সময় গোনাগুনতিতে শিক্ষকদেরও ভুল হয়। প্রায়ই দেখা যায় কেউ হয়তো দুই বা চার নম্বর বেশি পাবে; যেটা পরীক্ষক গুনতে ভুলে গিয়েছেন। সে জন্যে মাস্টারমশাইরাই বলে দেন, যাতে ওরা প্রাপ্ত নম্বরগুলো গুনে যাচাই করে নেয়।
অনুরাধাও উত্তরপত্র খুলে লাল কালিতে লেখা নম্বরগুলো গুনতে লাগল। কিন্তু এ কী! প্রথম বার গুনেই যেন মনে হল, যোগফলে ভুল আছে। অনুরাধা আরও এক বার গুনল। কিন্তু নাঃ, যোগফল পরীক্ষকের দেওয়া নম্বরের সঙ্গে মিলছে না! এর পর দু’বার, তিন বার করে ও গুনল। প্রতিবারই যোগফল প্রাপ্ত নম্বরের থেকে আলাদা হচ্ছে। অনুরাধা নিশ্চিত হল ওকে ভুল নম্বর দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ও ছুটল অঙ্কের সমীরণ মাস্টারমশাইয়ের কাছে, যিনি উত্তরপত্রগুলো দেখেছেন।
মাস্টারমশাই তখন কমনরুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। অনুরাধা অনুমতি নিয়ে কমনরুমে ঢুকে সরাসরি তাঁর কাছে চলে এল। ওর হাতে উত্তরপত্র দেখেই মাস্টারমশাই ওর আগমনের কারণ বুঝে গেলেন। ভাল ছাত্রী বলে অনুরাধাকে মাস্টারমশাইরা বিশেষ স্নেহ করেন। তা ছাড়া ওর কবিতা লেখা ও ছবি আঁকার প্রতিভার জন্যেও ও সবার কাছে খুব প্রিয় ছাত্রী। ওকে দেখেই মাস্টারমশাই বললেন, কী রে অনুরাধা, নম্বরে গণ্ডগোল হয়েছে বুঝি?
অনুরাধা সম্মতি জানিয়ে বলে, হ্যাঁ স্যর, তিন নম্বর কম হয়েছে।
তাই বুঝি? তিন নম্বর কম? দে দেখি খাতাটা এক্ষুনি ঠিক করে দিচ্ছি।
এই বলে মাস্টারমশাই ওর হাত থেকে খাতাটা নিয়ে, কিছু যাচাই না করেই আগের প্রাপ্ত বিরাশির সঙ্গে আরও তিন নম্বর যোগ করে দিলেন।
এই দেখে সঙ্গে সঙ্গে অনুরাধা বলে ওঠে, না না স্যর, আমি তিন নম্বর আরও কম পাব। নম্বরগুলো যোগ করে দেখলাম আমার উনআশি হচ্ছে।
অনুরাধার কথা শুনে মাস্টারমশাই হঠাৎ থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন অনুরাধার দিকে। আসলে এমন ঘটনা কমই ঘটে। অন্তত তাঁর অভিজ্ঞাতায় এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল। সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা বেশি নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা দেখলেই উত্তরপত্র নিয়ে আসে ঠিক করাতে। কিন্তু প্রাপ্ত নম্বরের থেকেও কম পাবে বলে উত্তরপত্র দেখাতে কেউ কখনও আসেনি। পরীক্ষক ভুলবশত বেশি নম্বর দিয়ে ফেললেও ছাত্রছাত্রীরা সচরাচর সেটা বেমালুম চেপে যায়। আর অনুরাধা কিনা সেই কাজটাই করেছে! এটা জেনেও যে, তিনটে নম্বর কমে গেলেই ওর সব সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বাসুদেব আবারও সেরার জায়গায় এসে যাবে। মাস্টারমশাই সে জন্যে অত্যন্ত বিস্মিত। তিনি এ বারে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই ঠিকমত গুনে দেখেছিস তো অনুরাধা?
হ্যাঁ স্যর, অনেক বার গুনেছি।
তবে তো এ বারও অঙ্কে তোর হাইয়েস্ট মার্কস পাওয়া হল না।
জানি স্যর। অনুরাধা ম্লান হেসে বলে। ফাইনালে আবার চেষ্টা করব স্যর।
এ বারে মাস্টারমশাই মৃদু হাসলেন। তার পর ওর উত্তরপত্র নিয়ে আগের নম্বরগুলো কেটে উনআশি লিখলেন। অনুরাধা উত্তরপত্রটা ফেরত নিতে যেই হাত বাড়িয়েছে, মাস্টারমশাই বললেন, একটু দাঁড়া, এখনও আমার কাজ হয়নি।
এর পর মাস্টারমশাই যা করলেন, দেখে অনুরাধা হতবাক। প্রথমে ও বুঝেই উঠতে পারেনি তিনি কী করতে চলেছেন। মাস্টারমশাই উনআশি নম্বরের পাশে যোগ চিহ্ন দিয়ে আবার তিন লিখে সর্বমোট প্রাপ্ত নম্বর আগের মতো বিরাশি করে দিলেন। তার পর খাতাটা ওকে ফেরত দিতে দিতে বললেন, আমি ভুল লিখিনি, তুই বিরাশি নম্বরই পেয়েছিস। ওই আলাদা তিন নম্বর তোর সততার পুরস্কার। এ বারের অঙ্কে হাইয়েস্ট তুইই, বাসুদেব নয়।