হ্যালো 60’s

ষাটের দশক আমাদের প্রথম যৌবনের দশক, উচ্ছলতায় ভেসে যাওয়ার দশক, ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করার দশক, পশ্চিমবঙ্গে ও ভারতে রাজনৈতিক ইন্দ্রপতনের দশক। তখন টিভি ছিল না, কম্পিউটারের কথা ভাসা-ভাসা শুনেছি, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে, এমন কী ক্যালকুলেটরও দুর্লভ ছিল। ভীষণ চাপা প্যান্ট ফ্যাশন ছিল, যা দেখলে গুরুজনরা হয় রাগ করতেন, আর না হলে জিজ্ঞাসা করতেন, সেলাই করে পরা, না পরে সেলাই করা?

Advertisement

তথাগত রায়

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

১৯৬০-এর হিট হিন্দি ছবি ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’। রাজ কপূর-পদ্মিনী জুটির অভিনয় আর নাচ বক্স-অফিস বাজিমাত করেছিল

ষাটের দশক আমাদের প্রথম যৌবনের দশক, উচ্ছলতায় ভেসে যাওয়ার দশক, ছাত্রজীবন থেকে কর্মজীবনে প্রবেশ করার দশক, পশ্চিমবঙ্গে ও ভারতে রাজনৈতিক ইন্দ্রপতনের দশক। তখন টিভি ছিল না, কম্পিউটারের কথা ভাসা-ভাসা শুনেছি, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে, এমন কী ক্যালকুলেটরও দুর্লভ ছিল। ভীষণ চাপা প্যান্ট ফ্যাশন ছিল, যা দেখলে গুরুজনরা হয় রাগ করতেন, আর না হলে জিজ্ঞাসা করতেন, সেলাই করে পরা, না পরে সেলাই করা? সিনেমা হল-এ কলকাতা শহর ছেয়ে ছিল, বিনোদন বলতেই সিনেমা। আমরা রেডিয়ো শুনতাম— সকাল সাতটা চল্লিশে ও দুপুর সাড়ে বারোটায় রবীন্দ্রসংগীত, শনি-রবিবার দুপুর একটা চল্লিশ থেকে আড়াইটে পর্যন্ত অনুরোধের আসর, রবিবার দুপুর একটা থেকে দেড়টা কলকাতা ‘খ’-তে মিউজিকাল ব্যান্ডবক্স।

Advertisement

১৯৬১ সালে খুব কৃতিত্বের সঙ্গে এগারো ক্লাসের উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল, আমিও ভাবলাম, কী হনু রে! কিন্তু পরম প্রাপ্তিটা হয়নি— মেয়েদের ভাল লাগতে আরম্ভ করেছে, কিন্তু মেয়েরা আমাদের ধারেকাছেও ঘেঁষে না, কয়েক জন ভাগ্যবান ব্যতিক্রমী বাদে। এই রকম দীর্ঘশ্বাস বুকে নিয়ে, পরশুরামের সেই কবিতা বুকে করে: ‘নারী, বুঝিতে পারি না কবে, একান্ত আমারি তুমি হবে,/ কত দিনে ওগো কত দিনে, পারছি নে আর পারছি নে’, শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম। বয়স এখন প্রায় সত্তর হতে চলল, কিন্তু জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচ বছর হাওড়া শহরের ওই এক কোনায় কেটেছে।

কিন্তু বুকের দীর্ঘনিশ্বাস বুকেই রয়ে গেল। একেবারে, প্রায় একেবারে নারীবিবর্জিত জীবন। ‘প্রায়’ বলছি, কারণ দু’হাজার ছেলে এবং তেরোটি মেয়ে। ফলে তাদের মধ্যে যেটি সর্বশ্রেষ্ঠা, তার নামকরণ হয়ে গেল তার নামের দুটি আদ্যক্ষর নিয়ে একটি দুষ্প্রাপ্য ধাতুর নামে। তেমনই প্রায় প্রত্যেকের (অধ্যাপক সমেত) নামকরণ হয়েছিল। অতি সৌভাগ্যক্রমে আমি বাদ ছিলাম। খর্বকায় ছাত্রের নাম ‘নাটা গুলবাজ’, সুদর্শন ছাত্রের নাম ‘রোমিয়ো লম্পট’। কলেজ ছাড়ার অনেক কাল বাদে একটি ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী। খানিক ক্ষণ কথাবার্তার পর সে চলে গেল, স্ত্রী বললেন, ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে না তো! বললাম, কেমন করে করাব, ওর তো নাম জানি না, শুধু ‘ঝাঁটা’ বলে চিনি!

Advertisement

বি ই কলেজ হোস্টেলের কীর্তিকাহিনি সব বলতে গেলে পরিসরে কুলোবে না, সব কথা বলাও যাবে না। সিনেমা দেখার কথা বলি। অসম্ভব সিনেমা দেখতাম— দিনে তিনটে, সপ্তাহে সাত দিন, শিবরাত্রিতে সারা রাত (হাওড়ায় এই প্রথা চালু ছিল) পর্যন্ত দেখেছি। যা-তা সিনেমা সব, ‘টার্জান অউর জলপরী’, ‘ফৌলাদ’, ‘জিঙ্গারো’— কিচ্ছু বাদ যেত না। আমার একটি বন্ধু, নাম কল্যাণ (ক্লাসে তিনটে কল্যাণ ছিল বলে তার নাম ছিল ‘গোঁফ কলু’), ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’ এগারো বার দেখেছিল। ঝর্ণা, মায়াপুরী, অলকা, নবভারত, বঙ্গবাসী— এই পাঁচটা হল আমাদের বাঁধা ছিল। হাউসফুল হলেও, বি ই কলেজের ছেলে দেখলে এক্সট্রা চেয়ার পেতে বসিয়ে দিত, বিশেষত ঝর্ণায়।

একটা পরম প্রাপ্তি বি ই কলেজে হয়েছিল। ডিগ্রি নয়, বন্ধু। সেই সব পঞ্চান্ন বছরের পুরনো বন্ধুত্ব এখনও অটুট আছে, এখনও তাদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যে তৃপ্তি পাই তা আর কিছুতে পাই না।

আশ্চর্যের বিষয়, যদিও আমি কলেজ ছাড়ার চব্বিশ বছর পর রাজনীতিতে আসি, আমার রাজনৈতিক চিন্তার গোড়াপত্তন কিন্তু কলেজে থাকতেই হয়েছিল। সাধারণত যে ভাবে হয় সে ভাবে নয়— আমি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম বটে, কিন্তু ইউনিয়ন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ছিল, এখন যেমন আছে। হয়েছিল অন্য ভাবে।

যখন আমরা ফোর্থ ইয়ারে পড়ি তখন কয়েকটি ছেলে কোথা থেকে এসে ভর্তি হল। এটা একেবারে অভূতপূর্ব, কারণ ফার্স্ট ইয়ার ছাড়া ভর্তি হওয়া যায় না। তার পর তাদের সঙ্গে আলাপ হল, শুনলাম তারা পূর্ব পাকিস্তান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (তখন নাম ছিল EPUET, এখন BUET) থেকে এসেছে। হিন্দু হওয়ার অপরাধে তারা সে দেশ থেকে বিতাড়িত। সেটা ১৯৬৪ সাল।

আমার পিতৃতুল্য, সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী আমার বাবার অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিলেন। আমরা এক বাড়িতেই থাকতাম, ওঁর ছেলেমেয়েরা আমার আপন ভাইবোনের মতো। আমার শিক্ষা, মূল্যবোধ, অনেকটাই ওঁর কাছে পাওয়া— তার মধ্যে অচলা গাঁধীভক্তি, কংগ্রেসভক্তি, বামবিরোধিতা, সবই ছিল। কিন্তু এই ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হল, আমাদের এই ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে একটা বিরাট ফাঁকি আছে। এই চিন্তাই আমাকে কালক্রমে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও ভারতীয় জনতা পার্টিতে নিয়ে এসেছে।

প্রমথনাথ বিশী, যাঁকে আমি জেঠু বলতাম, তাঁর কাছে আমার ঋণ কোনও দিন শোধ হবে না। তাঁর কাছে আমি শুধু শিক্ষা ও মূল্যবোধই পাইনি, বই পড়ার অভ্যাস পেয়েছি এবং বহু সাহিত্যিকের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাঁদের মধ্যে আমার কাছে উজ্জ্বলতম স্মৃতি দুজনের: সৈয়দ মুজতবা আলী এবং রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত। আর এক পরম প্রাপ্তি তাঁর ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের কাছে থেকে শান্তিনিকেতনের জীবন সম্বন্ধে গল্প শোনা।

ষাটের দশকের শেষের দিক। তখন আমি কলেজ পাশ করে গেছি, দিল্লিতে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। কাগজে পড়লাম, উত্তরবঙ্গে নকশালবাড়ি বলে একটা জায়গায় একটা ছোটখাটো কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে। তখন রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতাম না, তার তাৎপর্যও বুঝিনি। বুঝেছিলাম কলকাতায় ফিরে আসার পরে। এই সর্বনাশা সংস্কৃতি আমার প্রথম যৌবনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেও গ্রাস করে ফেলেছিল। আমার অনেক অতিপরিচিত সহপাঠীও নিজের হাতে খুন করেছিল— কারণ চিনের চেয়ারম্যানকে আমাদের চেয়ারম্যান বানাতে হবে।

এর মধ্যে ১৯৬৭তে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার এল। বেশ কিছুটা নৈরাজ্য তৈরি হল। তার পর থেকে সেই নৈরাজ্য বেড়েছে, কমেছে, কিন্তু আমাদের ছাড়েনি। ষাটের দশক কবেই শেষ, কিন্তু সেই অভিশপ্ত পরম্পরা আজও বাঙালি বহন করে চলেছে।

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন