শিশির মঞ্চে এক কবিতা-সন্ধ্যা। ডান দিক থেকে পর পর বসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। ১৪ অগস্ট ১৯৯১
নব্বইয়ের গোড়ার দিক হবে। কফিহাউসটাই ছিল ঘরবাড়ি। সকাল হতে না হতে কোনও রকমে ভাত খেয়ে দৌড়। তার পর যত ক্ষণ না বেল পড়ে, টিউব নেভে। নীচে নেমেও আর এক প্রস্থ। সবই কবিতার আড্ডা। যে দু’চার জন বন্ধু গল্প লিখত, তারা অবধি কবিতার প্রতাপের সামনে অসহায় বোধ করত। গল্প-উপন্যাসের প্রসঙ্গ উঠতই না। এক এক দিন কফিহাউসের টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি। আমাকে ডেকে তুলেছে কফিহাউসের সবচেয়ে রূপবান বেয়ারাটা। নীচে নেমে দেখি, সিগারেটের দোকান বন্ধ। মাথায় মুকুট নেই বলে কেউ ধারও দেবে না। এ রকমই জীবন কাটছে। কখনও দুপুরের মধ্যে জড়ো হওয়া, তার পর সোজা খালাসিটোলা। কাউন্টারের ও-পারে অনিলদার চশমাপরা হাসিমাখা মুখ। রোজই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন, ওই দিকে কমলবাবু ধুতি-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়াতেন। আমরা মিলনদার দোকানের কুচো চিংড়ির ঝাল বা মুরগির ছাঁট অথবা সুরিন্দরের দোকানের চানাচুরমাখা, পেয়ারা দিয়ে বিশুদ্ধ হলাহল পান করে মাঝরাস্তায় দেখাতাম হাজার ম্যাজিক। বেশির ভাগ দিনই ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে ফাঁকা টেম্পোয় উঠে কফিহাউসের সামনে ট্রামরাস্তায় নেমে পড়া। ভাড়া হিসেবে ড্রাইভারকে চুমু খেতে যাওয়া।
এ সবই কবিতা লেখার আয়োজন। এরই মধ্যে চার পাতা, কখনও আট পাতার একটা পত্রিকা বেরোত আমাদের। পনেরো দিন অন্তর বার করার কথা। তবে সব সময় হয়ে উঠত না। পত্রিকা কবে বেরোবে সে জন্য বড়রাও প্রতীক্ষায় থাকতেন। কেননা এই পত্রিকায় নতুন নতুন ছেলেমেয়ে লিখতে এসেছে, আমাদের চার পাশে সব নতুন কবিতা লেখার বন্ধু। সেই সঙ্গে একটা গানের দলও তৈরি হয়েছে। খোল ও স্প্যানিশ সহ। আদাড়ে-বাদাড়ে, যেখানে-সেখানে কবিতা আর গানের হদ্দমুদ্দ হচ্ছে।
এ রকমই দিন কাটতে কাটতে এল পঁচিশে বৈশাখ। নন্দন চত্বর থেকে বেরিয়ে সোজা খালাসিটোলায়। সে দিন আমরা চার জন। সকলের পকেটেই পয়সা আজ। বাইরে ঠাকুরদার দোকান থেকে ডাব কিনে আনা হল। ডাবের জল মিশিয়ে খাওয়া হবে। খালাসিটোলায় ফ্যানের নিচটা সকলেই আমাদের দলটাকে ছেড়ে দেয়, কেননা আমরা কবিতা নিয়ে অনেক কথা বলি। সে দিন পানাহারের আড্ডায় মনে পড়ল, আরে, সন্ধেবেলা কবিতা পড়বেন সব বিখ্যাত কবি, রবীন্দ্র সদনে। ওখানে ঢুকতে কার্ড লাগে। কী করা যায়? এক জনকেই ফোন করে বলা যায়। পানাহার খানিক সময়ের জন্য বন্ধ রেখে খালাসিটোলার উলটো দিকে কলকাতা টেলিফোনের অফিসে যাওয়া। মূল গেট দিয়ে ঢুকে দু’দিকে দুটো দুটো করে চারটে বুথ ছিল। তখনও কালো রঙের রিসিভার। আঙুল ঘুরিয়ে ফোনের রোম্যান্টিকতা ছিল। এক টাকার কয়েন ফেলে তাঁকে ফোন। ও পারে সহাস্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়:
কী ব্যাপার এ অসময়ে?
আজ তো রবীন্দ্র সদনে আপনাদের কবিতা পড়া?
হ্যা।ঁ
আমরা চার জন আছি, শুনতে যাব।
তা বেশ, চলে এসো।
কিন্তু আমাদের ঢোকার কার্ড নেই। আপনার সঙ্গে ঢুকব।
আমার সঙ্গে ঢুকলে সদনের পেছনের দিকে দাঁড়াও সাড়ে পাঁচটা নাগাদ।
সাড়ে পাঁচটার আগেই আমরা হাজির। একটু পরেই নীল মারুতি ভ্যান থেকে নামলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর দু’পাশে জয় গোস্বামী আর জয়দেব বসু। আর কোনও দিনও যে দৃশ্য দেখা যাবে না। আমাদের দলটাকে দেখে বললেন, কী, সকাল থেকেই চলছে? এসো এসো। উইংস-এর পাশে বেঞ্চিতে বোসো। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমার কথা বোলো। হঠাৎই দেখি, পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি, চলো গিয়ে আমাদের অনুরোধের আসর চালু করি। সামনে যেতে ভারী চশমা ভারী গোঁফের ফাঁক দিয়ে স্মিত হাসি, কী চাই?
কয়েকটা কবিতা পড়ার রিকোয়েস্ট ছিল।
বলো।
আমরা গোটা তিনেক কবিতার নাম বলি। বলে বলি, ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ থেকে। চুপ করে থাকেন। মুখের ওপর পাতলা ছায়া খেলে যায়। বললেন, এখন আর লিখতে পারি না, না! প্রথম বই থেকেই সব অনুরোধ করেছ!
এ রকমই কবিতাযাপন হয়ে চলেছিল। এক বার কলকাতা থেকে দু’তিন গাড়ি বোঝাই হয়ে গেলাম হলদিয়ায়। উদ্যোক্তা তমালিকা পণ্ডা শেঠ। পিছনে অবশ্যই লক্ষ্মণ শেঠ। কবিতা উৎসবের উদ্বোধনের পর ঘোষণা করা হল, কে কোথায় থাকবে। আমাদের দু’তিন জনের নামই নেই। এ দিকে সুনীলদাকে রাখা হবে পাঁচতারা খচিত একটি হোটেলে। সেখানে আরও কয়েক জন প্রবীণ কবি থাকবেন। আমরা দেখে নিই, কে কে আসেননি। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা গাড়িটি নিয়ে সোজা সেই হোটেলে। রিসেপশনে গিয়ে বলি, আমি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। আমার গুঁফো বন্ধু দাবি করে, সে নবনীতা দেব সেন। হোটেলের কর্মীরা প্রশ্ন করে না। বেয়ারা দিয়ে চাবি দিয়ে ঘর খুলে দেয়। সুশীতল ঘর। বিয়ার ঠান্ডা। পরে দেখা যাবে কী হবে না হবে। এমন সময় বেল বাজে। দরজা খুলতে একটা দল দাঁড়ানো। আপনি অলোকরঞ্জন?
হ্যাঁ আমি অলোকরঞ্জন।
আপনি বলছেন আপনি অলোকরঞ্জন আর আপনার বন্ধু নবনীতা দেব সেন!
আমি বন্ধুটিকে দেখিয়ে বললাম, ‘এর বাবা চ্যাংড়াবান্ধার বি.ডি.ও। তিনি নবনীতার এমন ফ্যান, ঠিক করেছিলেন মেয়ে হলে নাম রাখবেন নবনীতা। তা, ছেলে যদি বাবার সাধ পূর্ণ করে এক-আধ বার, সেটা কি খারাপ?’ ওরা বলল, চলুন লক্ষ্মণদা ডাকছে। যেতে যেতে শুনতে পাই, ‘শালাদের মেদিনীপুর পেরোতে দেব না।’
আমাদের নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করা হয় উৎসব ভবনের কাছে। বিরাট জটলা। লক্ষ্মণ শেঠ দাঁড়িয়ে। আমাদের চেনাজানা কিছু সিনিয়র কবি নিচু গলায় ছিছি, ছ্যাছ্যা করে চলেছেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে কমলা পাঞ্জাবি পরা সুনীলদা এগিয়ে এলেন, এই এ সব ছাড়ো, ছাড়ো। এ সব পাগলামো তো কবিরাই করবে। আমি আর শক্তি প্রেমেন্দ্র মিত্রর নাম করে এক বার ঢুকে পড়েছিলাম উত্তরবঙ্গে। ঠিক কোথায় মনে পড়ছে না।
এ রকমই কবিতাজীবন। শুধু আচমকা অনেকগুলো চরিত্র চলে গেল। তাদের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না।
নব্বইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in