ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।
বাস্তবটা নিয়ে আমি এতই অস্বস্তিতে থাকি যে প্লেনে চড়লে বরং আরাম লাগে। যে মুভিগুলো দেখতে চাই না, যে খাবার কক্ষনও খেতে চাই না, তাদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করি। আকাশে উড়ছি, সেলফোন বন্ধ, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেই, এই নির্বাণকালকে উপভোগ করি খুব। আমার কাছে উড়ান মানে কাছে ঘেঁষতে চাওয়া কিছু নম্বরকে ঠেকিয়ে রাখা।
টেক-অফের আগে শেষ কলটা ছিল ক্লারার। তখন বার্সেলোনা এয়ারপোর্টে, ফোনে ওর উদ্বিগ্ন গলা, ‘ও কি ফিরবে, তোমার কী মনে হয়?’ ‘ও’ মানে উনিকা, আমাদের বেড়াল। ‘কেন, ভূমিকম্পটম্প কিছু হয়েছে?’ আমি বললাম। বেড়ালরা ভূমিকম্প টের পায়। কিন্তু উনিকা এরই মধ্যে দু’বার পালিয়েছে, কোনও ভূমিকম্পর নামগন্ধ ছাড়াই। ‘ওর মনের মধ্যে হয়তো কাঁপাকাঁপি হচ্ছে কিছু’, ক্লারা রগড় করছিল। জানাল, রেন্ডন-রা ওকে ভেল দে ব্রাভো-তে বেড়াতে আসার নেমন্তন্ন করেছে। আমার প্লেন সময়মত না পৌঁছলে ও একাই বেরিয়ে যাবে। আলো-ঝলমল, নৌকো-ভাসানো একটা উইকএন্ড-এর জন্য ওর পরান পুড়ছে।
‘তুমি কি জীবনে একটা ডিরেক্ট ফ্লাইটে আসবে না?’ ফোন ছাড়ার আগে ক্লারা বলেছিল। আমার জীবনটা এমনই, ত্যাড়াব্যাঁকা। বার্সেলোনা থেকে প্লেন ছাড়লই দেরিতে। এখন লন্ডনের ওপর চক্কর খাচ্ছি, নামার সময় পেরিয়ে গেছে কখন। ‘আমরা এখন একটা হোল্ডিং প্যাটার্ন-এ আছি, অর্থাৎ উড়ান-পথে থিতু হয়ে, ল্যান্ডিংয়ের প্রতীক্ষায়’, পাইলট জানায়। আমাদের নামার কোনও জায়গা নেই। একটা রানওয়ে ফাঁকা না হওয়া অবধি আমরা ভনভনে মাছির মতো উড়তেই থাকব। লন্ডনের সময় বার্সেলোনার থেকে এক ঘণ্টা পিছিয়ে। যে ঘণ্টাটা এখনও পেরোয়নি, সে সময়টায় ফোনগুলো সেরে নেওয়া যায়। কিন্তু আমি আর ও নিয়ে ভাবতে চাই না। আমাকে টার্মিনাল দুই থেকে চারে যাওয়ার বাস ধরতে হবে। এয়ারপোর্টগুলো আমার বেশ লাগে। সব ক’টা টেনশনের আখড়া। বাইরের দুনিয়াটা যেন ভ্যানিশ। তোমার গেটের দিকে ছোটো। গেট নম্বর ছয়ই তোমার একমাত্র লক্ষ্য।
ক্লারার এত কল মিস করেছি যে ও নির্ঘাত ভেবে বসে আছে, এ সব আমার আগে থেকেই ছকে রাখা। ‘এ রকম ব্যাড লাক কারও হয়, বললেই হল?’ ফ্র্যাংকফুর্টে তুষারপাত। বারাজাসে ধর্মঘট। এমন সব হোটেলে ঘুমোতে হয়েছে, তুমি হলে সুইসাইড করতে। ক্লারা কিছুটা তো ঠিকই: আমার মন্দ ভাগ্য বটে, কিন্তু খুব মন্দ নয়। হিথরোয় এক বার, গোলাপি একটা আকাশের তলায়, একটা ফ্লাইট মিস করেছিলাম। যে হোটেলটায় থাকতে হয়েছিল, বেশ ভালই। আর তক্ষুনি হঠাৎ ন্যান্সির সঙ্গে লবিতে দেখা। সেও প্লেন মিস করেছে। একই কোম্পানির হয়ে আমরা চাকরি করতাম, যদিও বহু দূরের দুই শহরে। আমরা একটা পাব-এ রাতে খেলাম, যেটায় চেলসির খেলা চলছিল। দুজনের কেউই ফুটবল নিয়ে আদৌ আগ্রহী না, তাও খুব মনোযোগ দিয়ে খেলাটা দেখলাম। ধার করা এইটুকু তো সময়। ন্যান্সিকে আমার বরাবরই পছন্দ, কিন্তু ওই মুহূর্তে, সময়ের গণ্ডিভাঙা ওই সময়টায়, ওর হাতটা টেনে নিয়ে ওয়েডিং ব্যান্ডটা নিয়ে খেলা করা যায় বলে মনে হয়েছিল আমার।
ভোরে ও আমার রুম থেকে চলে গেল। নীচের ঠান্ডা রাস্তায় ওর আবছা অবয়ব। কন্ট্রোল টাওয়ারগুলো দেখে মনে হচ্ছিল দুটো বেভুল লাইটহাউস, রেডারগুলো সিগনালের সন্ধানে ঘুরে মরছে। আমার হাতে লেগে থাকা ন্যান্সির পারফিউমের গন্ধ বুক ভরে নিলাম, আর পৃথিবীর কৃত্রিম এক সৌন্দর্যবোধ, অ্যাদ্দিন যার স্বাদ পাইনি, আমায় বিঁধল।
সেই হিথরোর ওপর উড়ছি এখন, আবার। ন্যান্সির এ বারও একটা ফ্লাইট মিস করার চান্স কতটা? হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে, সম্পর্কের জ্যামিতিটা অস্বীকার করতে পারব? আবারও দেখা হবে, ন্যান্সি তেমন কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। তবু, অনিশ্চয়তায় ভরা ওর গলার স্বরকে উপেক্ষা করতে পারিনি যখন ও বলল, ‘টেক অফের সময়ও জানি যে অমুক জায়গায় যাচ্ছি। কিন্তু এক ঈশ্বরই জানেন, কোথায় ল্যান্ড করব।’ বলে ও আমার বুকে হেলান দিয়ে শুল।
ম্যাগাজিনে চোখ বোলালাম। সুন্দর নিসর্গ, নামজাদা আর্কিটেক্টের মুখ, আর তার পরই, একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে, এলিয়া রুবিয়ো-র একটা ছোটগল্প। ইদানীং যদিও ওর গল্প প্রায়ই ছাপা হয়, তবু, ওর লেখা মানেই দারুণ কোনও চমক থাকবেই। এলিয়ার সঙ্গেই ক্লারার বিয়ের সব ঠিকঠাক ছিল। আসলে ক্লারার এমন একটা স্টাইল আছে, যা যে কোনও পুরুষকে আকর্ষণ করে। আর এলিয়ার লেখায় আজ অবধি যত প্যারাগ্রাফ পড়েছি, মনে হয়েছে, ও আজও ক্লারাকে মেসেজ করে।
কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার আগে হাতে সময় বিশেষ ছিল না। আর আমি যে ইচ্ছে করে প্লেন মিস করিনি, ক্লারাকে সেটা বোঝানোর জব্বর একটা অজুহাতও খুঁজছিলাম। দরকার ছিল শুধু আর একটা সমস্যার। সে জন্যই গল্পটা পড়লাম। এলিয়াটা একটা জোঁক, বাস্তবকে পুরো শুষে নিয়ে লেখে। বাস্তবকে নিয়ে আমার এত যে অস্বস্তি, তার একটা কারণ এটাও।
উনিকা প্রথম যে বার পালাল, আমরা টেলিফোনের খাম্বায় ওর পোস্টার সাঁটিয়েছিলাম, পাড়ার ভেট-এর কাছে আমাদের ফোন নম্বর রেখে এসেছিলাম, ‘পালিয়ে যাওয়া পুষ্যি’ বিষয়ে একটা রেডিয়ো শো-তেও গিয়েছিলাম।
মেয়ে-বেড়ালগুলো পালায় না, কিন্তু আমাদেরটা পালিয়ে গিয়েছিল। এক বিকেলে ক্লারা জিজ্ঞেস করল, ও যে কোনও দিন মা হতে পারবে না, তা নিয়ে আমার সত্যিই কিছু যায় আসে কি না। ও সদ্য এক কাপ ইন্ডিয়ান চা খেয়ে উঠেছিল, ওর বলা কথাগুলোয় লবঙ্গের গন্ধ লেগে ছিল। আমি বললাম, সত্যিই কিছু এসে যায় না। আমি বেড়ালটার উদ্ভট নাম নিয়ে ভাবছিলাম। উনিকা— যার মানে ‘একমাত্র সন্তান’— নামটা ক্লারা এক পোঁচ মজা করে রেখেছিল, আর এই ক’বছরে নামটা হয়ে উঠেছিল বেদনার্দ্র একটা বিদ্রুপ। আমি যখন চোখ তুলে চাইলাম, ক্লারা উঠোনের দিকে চেয়ে কিছু একটা দেখছে। অন্ধকার হয়ে আসছিল। ক্লারা আমার হাত চেপে ধরল। একটু পর আমরা উনিকার জামাটা খুঁজে পেলাম, ওর অনুপস্থিতিতে যেটা ঝ্যালঝেলে হয়ে গিয়েছিল।
সে রাতে ক্লারা শুকনো বৃষ্টির মতো ওর আঙুলগুলো দিয়ে আমার গায়ে হাত বোলাচ্ছিল। মানে এলিয়া ওর গল্পে এ রকমটাই লিখেছে। গল্পটার নামও জঘন্য: ‘তৃতীয় পক্ষ’। ও কি নিজেকে বোঝাতে চাইছে? ক্লারার সঙ্গে ও কি এখনও দেখা করে? ক্লারাই কি ওকে এই সব খুঁটিনাটি বলেছে? বদমাশ গপ্পোকারটা আবার ক্লারার একটা অভ্যেস দারুণ লিখেছে: ও ওর চুলগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে রিং বানায়। হাত থেকে চুল সরায় তখনই, যখন ও এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেটা ও বুঝিয়ে বলতে পারবে না।
পড়তে পড়তে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। এলিয়া আমাদের বেড়ালটার দ্বিতীয় বারের অন্তর্ধান নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে! নায়িকা তার প্রেমিকের সঙ্গে আপস করে ভাবছে, তৃপ্তি ব্যাপারটা আসলে যাবতীয় দুশ্চিন্তার শেষ। বেড়ালটার ফিরে আসায় বৃত্ত সম্পূর্ণ হল: ফের সব কিছু ঠিকঠাক, তবু, জীবনে একটা কোনও পরিবর্তন, একটা ফাটল দরকার। মেয়েটা ওর চুলগুলো জড়িয়ে রিং বানাচ্ছিল, আবার ছেড়ে দিচ্ছিল। কাউকে কিচ্ছুটি না বলে ও আসলে বেড়ালটাকে গ্রামে ছেড়ে দিয়ে আসতে যাচ্ছিল।
সত্যি কি এটাই ঘটেছে? ক্লারাই কি বেড়ালটাকে সরিয়ে দিল, যাতে ও আমার না-থাকার ওপর দোষটা চাপাতে পারে, অথবা নিজের চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারে? এলিয়ার গল্পগুলো সব রিভেঞ্জ ফ্যান্টাসি, কিন্তু সেগুলোর প্লট ওর নিজের কল্পনাপ্রসূত নয়। অজস্র খুঁটিনাটি সত্যি। এই গল্পে উনিকা কীসের প্রতীক? নায়িকা কি বেড়ালটাকে মুক্তি দিয়ে নিজেরই মুক্তি খুঁজে নিল? বার্সেলোনায় ফোনে ক্লারা যখন উনিকার কথা বলছিল, যেন কোড ল্যাংগোয়েজে বলছিল। সেটা বুঝলাম এই এক্ষুনি, যখন লন্ডনের ওপর ভেসে আছি।
নিশ্চল, স্থবির একটা পরিস্থিতি: যদি আমি ঠিক সময়ে না ফিরি, ক্লারা উইকএন্ড কাটাতে যাবে রেন্ডনদের ওখানে, যারা অনেক কাল আগে এক দিন ওকে এলিয়া রুবিয়ো-র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
ধাতব একটা শব্দ, ল্যান্ডিং গিয়ার। ফ্লাইটটা পাব মনে হয়। টার্মিনাল চার, গেট নং ছয়।
বেড়ালরা ভূমিকম্প বুঝতে পারে। ক্লারাও কি আমার ফ্লাইট মিস করাটা আগাম বুঝতে পারছে? আমার দেশে এখন ক’টা বাজে? ও কি ওর চুলগুলো জড়িয়ে জড়িয়ে রিং বানাচ্ছে এখন? আমি গেটে পৌঁছনোর আগেই কি ও রিংটা ছেড়ে দেবে? হিথরোর আকাশ কি আজ গোলাপি? আর কেউও কি প্লেন মিস করছে? আমাদের প্লেনটা কি অন্য কোনও প্লেনের জায়গা কেড়ে নিচ্ছে, যেটা হয়তো ঠিক সময়ে ল্যান্ড করতে পারত?
টার্বাইনগুলো কান-ফাটানো গর্জন করছে। আমরা নামছি। আবারও আর একটা যুক্তিজালে বাঁধা পড়তে হবে ভেবে আমার শরীরটা কেমন অসাড় বোধ হতে থাকে।
মাটিতে যেমনটা হয় আর কী। আকাশের জ্যামিতি।
(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ শিশির রায়।