ছবি: এআই সহায়তায় প্রণীত।
মধ্য চিনের উনিয়াং অববাহিকা থেকে মিলেছিল কতকগুলি ডায়নোসরের ডিম। সেখানকার কিংলংশান এলাকায় পড়েছিল ডিমগুলি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই ডিমগুলির বয়স প্রায় আট কোটি ৬০ লক্ষ বছর। আধুনিক ‘পারমাণবিক ঘড়ি’ পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই ডিমের বয়স নির্ধারণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই ডিমের সূত্র ধরেই এখন বিজ্ঞানীরা জানতে চাইছেন, চিনের ওই এলাকায় কী ভাবে ঘুরে বেড়াত ডায়নোসরেরা। কী ভাবে জীবনযাপন করত তারা। কী ভাবেই বা কোটি কোটি বছর ধরে ডিমগুলি অক্ষত রয়ে গেল।
‘ফ্রন্টিয়ের ইন আর্থ সায়েন্স’-এ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ডায়নোসরের ডিমের বয়স অনুসন্ধানের বিষয়টি জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, কার্বোনেট ইউরেনিয়াম-লেড (ইউ-পিবি) ডেটিং পদ্ধতিতে এই প্রথম বার সরাসরি ডায়নোসরের ডিমের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। কার্বনেট জাতীয় খনিজ— যেগুলির মধ্যে ক্যালশিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম থাকে, সেগুলির বয়স নির্ধারণের জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এই খনিজগুলিতে থাকা ইউরেনিয়াম ক্রমে লেড বা সীসায় পরিণত হয়। এই সীসার পরমাণু পরীক্ষা করেই বয়স নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
হুবেই ইনস্টিটিউট অফ জিওসায়েন্সের অধ্যাপক বি ঝাও জানিয়েছেন, ডায়নোসরের ডিমগুলি প্রায় সাড়ে আট কোটি বছর আগে পাড়া হয়েছিল। ক্রেটাসিয়াস যুগের শেষ দিকের ঘটনা বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সে সময় পৃথিবী শীতল হতে শুরু করেছিল। ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে শেষ হয়েছিল এই যুগ।
চিনের এই কিংলংশানে এর আগেও বহু বার ডায়নোসরের ডিমের জীবাশ্ম মিলেছে। এই এলাকার তিনটি জায়গা থেকে প্রায় তিন হাজার ডিমের জীবাশ্ম মিলেছে। বেশির ভাগ ডিমই ডেনড্রুলিথিডায়ে পরিবারের প্লাকুলিথাস টিউমিয়াওলিনজেনসিস প্রজাতির। সেগুলি থ্রিডি হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। ডিমগুলি একটু চ্যাপ্টা আকারের। তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.৭ থেকে ৬.৭ ইঞ্চি। খোলাটি এখন ০.০৯ ইঞ্চির বেশি পুরু নয়। বেশির ভাগ ডিমের বিষয়েই খুব বেশি তথ্য মেলেনি। যে ডায়নোসরেরা এই ডিম পেড়েছিল, তাদের আকার-প্রকারও স্থির করে উঠতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
কী ভাবে নির্ধারণ হল বয়স?
কিংলংশানে প্রায় ২৮টি ডিম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা সম্প্রতি কয়েকটি ডিমের খোলায় ক্যালসাইট পেয়েছিলেন। এই ক্যালসাইট হল ক্যালশিয়াম কার্বনেটের রূপ। তার পরেই তাঁরা বুঝতে পারেন, এই ডিমের খোলাগুলির ইউ-পিবি ডেটিং করা যেতে পারে। অধ্যাপক ঝাও জানিয়েছেন, ইউ-পিবি ডেটিং করে এতটা নির্ভুল ভাবে যে ওই ডায়নোসরের ডিমের বয়স নির্ধারণ করা যাবে, তা আশা করেননি তাঁরা। প্রথমে শুধুই চেষ্টা করেছিলেন। এ বার সেই চেষ্টাই সফল।
এর আগে শিলার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে এই ইউ-পিবি ডেটিং পদ্ধতিতে। এ বার ডিমেরও বয়স নির্ধারণ করা হল। কী ভাবে ওই ডায়নোসরের ডিমের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছেন ঝাও। তিনি জানান, ডিমের খোলার নমুনা নিয়ে তার মধ্যে জমে থাকা কার্বনেট বাষ্পে পরিণত করা হয়। তার মধ্যে ইউরেনিয়াম এবং লেডের পরমাণু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন বিজ্ঞানীরা। ইউরেনিয়াম ক্ষয়ীভূত হয়ে লেডে পরিণত হয়। সেই লেড পরীক্ষা করেই সাধারণত বয়স নির্ধারণ করা হয়। সে ভাবেই জানা গিয়েছে ডায়নোসরের এই ডিম পাড়া হয়েছিল প্রায় সাড়ে আট কোটি বছর আগে। প্রকৃত বয়স তার চেয়ে বড়জোর ১৭ লক্ষ বছর বেশি বা কম হতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
এমনিতে বিজ্ঞানীরা প্রাণী বা উদ্ভিদের জীবাশ্মের বয়স নির্ধারণ করেন, যে মাটি বা পলিতে তারা মেলে, তা পরীক্ষা করে। তবে সব ক্ষেত্রে এই পরীক্ষায় জীবাশ্মের সঠিক বয়স নির্ধারণ করা যায় না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই লাভার মাধ্যমে ওই জীবাশ্ম অন্য কোনও জায়গা থেকে উদ্ধারস্থলে এসে পড়ে। মনে করা হচ্ছে, এই ইউ-পিবি পদ্ধতিতে অনেকটাই নির্ভুল ভাবে নির্ধারণ করা যাবে জীবাশ্মের বয়স। ঝাও জানিয়েছেন, এ বার অন্য জীবাশ্মের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হতে পারে এই পদ্ধতি। বিশ্বের প্রায় ২০০টি জায়গা থেকে ডায়নোসরের ডিম উদ্ধার হয়েছে। ঝাও জানাচ্ছেন, অন্য জায়গাগুলি থেকে মেলা ডিমের বয়স এত ‘নিখুঁত ভাবে’ নির্ধারণ করা যায়নি। নতুন এই পদ্ধতিতে এ বার সে সবের বয়সও নির্ধারণ করা যেতে পারে। এর ফলে ডায়নোসরের বিবর্তন, অবলুপ্তির বিষয়ে অনেক তথ্য মিলবে।