science news

অপচয় ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহণ! নতুন যৌগের আবিষ্কার

যে পদার্থের মধ্যে দিয়ে যেতে গেলে বিদ্যুৎশক্তির কোনও অপচয়ই হয় না।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২০ ১২:০৭
Share:

উপরে, নীচে দু’টি হিরে। মাঝখানে সদ্য আবিষ্কৃত অতিপরিবাহী পদার্থ। ছবি- ‘নেচার’ জার্নালের সৌজন্যে।

এ বার কি তবে কোনও অপচয় ছাড়াই বিদ্যুৎশক্তির পরিবহণ সম্ভব হবে? সাম্প্রতিক একটি আবিষ্কার সেই সম্ভাবনাকে এই প্রথম অত্যন্ত জোরালো করে তুলল।

Advertisement

খোঁজ মিলল এমন একটি পদার্থের যা ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও খুব ভাল অতিপরিবাহী। সুপারকন্ডাক্টর। যে পদার্থের মধ্যে দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে গেলে বিদ্যুৎশক্তির কোনও অপচয়ই হয় না। কারণ সেই পদার্থের মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হতে গিয়ে বিদ্যুৎশক্তিকে কোনও বাধাই পেতে হয় না।

১১০ বছরের প্রতীক্ষার পর শেষ পর্যন্ত হদিশ মিলল এমন একটি যৌগিক পদার্থের। যা আসলে হাইড্রোজেন, কার্বন আর সালফার, এই তিনটি মৌল দিয়ে তৈরি। আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। ১৪ অক্টোবর। এই আবিষ্কার করেছেন নিউ ইয়র্কের রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী রঙ্গা ডায়াস ও তাঁর সহযোগীরা।

Advertisement

গবেষকরা জানিয়েছেন, সদ্য আবিষ্কৃত পদার্থটি ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও অতিপরিবাহী। তুলনায় গরম আবহাওয়ার দেশগুলিতে এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে রাখলে ঘরে বা অফিসে যে তাপমাত্রার সঙ্গে আমরা খুবই অভ্যস্ত। আর ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়ার মতো দেশগুলিতে তো এই তাপমাত্রা রোজকার রুটিনের মধ্যেই পড়ে।

অপচয়ই বিদ্যুৎশক্তির পরিবহণে সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্রতি দিনই উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তির একটি বড় অংশের অপচয় হয় পরিহণের সময়। তার ফলে, বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায়। উৎপাদিত বিদ্যুৎশক্তিরও দাম বাড়ে। যতটা বিদ্যুৎশক্তি প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হন গ্রাহকরা।

গত ১১০ বছর ধরে এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার চেষ্টা চলছিল বিশ্বজুড়ে। ভারতেও এই প্রচেষ্টা চলছে বেশ কিছু দিন ধরে।

কিন্তু সমস্যার জট খুলছিল না। যে সব অতিপরিবাহী পদার্থের আবিষ্কার হয়েছে এর আগে, তাদের সবক’টির মধ্যেই অতিপরিবাহিতা ধর্মের হদিশ মিলেছে শূন্যের অনেক নীচের তাপমাত্রায়। তার ফলে, সেই সব পদার্থ দিয়ে অতিপরিবাহী তার বানানোর পথে এগনো সম্ভব হয়নি এত দিন।

আরও পড়ুন- আইনস্টাইনের সংশয় দূর করেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল রজার পেনরোজের

আরও পড়ুন- আমার বন্ধু রজার​

প্রতি বারই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে অত কম তাপমাত্রা। যা গরম আবহাওয়ার দেশগুলিতে বাস্তবিক ভাবে কোনও বিকল্প পথ দেখাতে পারেনি। তাই ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী পদার্থ আবিষ্কারের মরীয়া চেষ্টা চলছে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে।

‘‘এই আবিষ্কার সেই লক্ষ্যে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াল’’, বলছেন মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর)’-এর কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক প্রতাপ রায়চৌধুরী।

একই সুর দেশে বিজ্ঞানের গবেষণায় দ্বিজোত্তম প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)’-র অধ্যাপক অরিন্দম ঘোষেরও। তাঁর কথায়, ‘‘ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেও যে অতিপরিবাহী পদার্থ পাওয়া সম্ভব এই প্রথম তা দেখা গেল। যা এই গবেষণায় একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিল। কার্বন, হাইড্রোজেন ও সালফারের একটি যৌগের মধ্যে উচ্চ চাপে অতিপরিবাহিতা ধর্মের প্রকাশের ক্ষেত্রে যে যে বৈদ্যুতিক, চৌম্বক ও গাঠনিক পরিবর্তনগুলি হয়, তারও সবিস্তার ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে এই গবেষণায়।’’

তবে সদ্য আবিষ্কৃত অতিপরিবাহী পদার্থটির ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রেও আপাতত একটি সমস্যা রয়েছে।

প্রতাপ ও অরিন্দম দু’জনেই জানাচ্ছেন সেই সমস্যাটি চাপ সংক্রান্ত। এই পদার্থটির মধ্যে অতিপরিবাহিতা ধর্মের হদিশ পেতে গিয়ে গবেষকদের কৃত্রিম ভাবে যে পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি। আমাদের বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপের প্রায় ২৬ লক্ষ গুণ। তবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে (‘কোর’) তরল স্রোতের জন্য যে পরিমাণ চাপ সব সময়েই থাকে তা আমাদের বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক চাপের ৩০ লক্ষ গুণ।

অরিন্দম ও প্রতাপ বলছেন, ‘‘বাইরে থেকে দেওয়া এই চাপের পরিমাণও আগামী দিনে কমানো যেতে পারে। সেটা সম্ভব হতে পারে এমন ধরনের অন্য কোনও যৌগিক পদার্থ বা কেলাসের আবিষ্কারে। যে পদার্থ বা কেলাসে থাকা বিভিন্ন মৌলের পরমাণু একে অন্যকে আরও জোরালো শক্তিশালী বন্ধনে (‘কেমিক্যাল বন্ড’) ধরে ও বেঁধে রেখেছে। ফলে, সেই পরমাণুগুলির অভ্যন্তরীণ চাপ অনেক বেশি। তাতে সেই পদার্থ বা কেলাসে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতা পেতে বাইরে থেকে অত বেশি পরিমাণে চাপ প্রয়োগের প্রয়োজন হবে না।’’

প্রতাপ জানাচ্ছেন, এই আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে এক শতাব্দী আগেকার একটি পূর্বাভাস। যেখানে বলা হয়েছিল পর্যায় সারণীর প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের মধ্যেও ধাতব ধর্ম দেখা যেতে পারে। সেটা তখন হবে ‘মেটালিক হাইড্রোজেন’। শূন্যের অনেক নীচের তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন গ্যাস (ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন থাকে গ্যাসীয় অবস্থায়) যখন কঠিন (‘সলিড’) অবস্থায় পৌঁছয় তখন তার ভিতরের অণুগুলির সজ্জা-বিন্যাসের কারণে সেই হাইড্রোজেনের মধ্যে ধাতব ধর্ম দেখতে পাওয়া সম্ভব। উচ্চ চাপে। এটা বলেছিলেন দুই বিজ্ঞানী ভিগনার এবং হাটিংটন। ১৯৩৫ সালে। তবে সেই ধাতব হাইড্রোজেনের মধ্যে অতিপরিবাহিতাও পাওয়া যাবে কি না সে ব্যাপারে তাঁরা কিছু বলতে পারেননি।

শূন্যের নীচে ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে বলা হয় কেলভিন। মহাকাশের তাপমাত্রা প্রায় ২ ডিগ্রি কেলভিন। এর আগে দেখা গিয়েছিল হাইড্রোজেন গ্যাস ২০ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রার নীচে তরল হয়ে যায়। আর কঠিন হয়ে যায় ১৪ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রার নীচে। কিন্তু সেই সময় হাইড্রোজেন থাকে আণবিক কঠিন অবস্থায়। যেখানে প্রথমে দু’টি হাইড্রোজেন নিজেদের মধ্যে জোড় বেঁধে হাইড্রোজেন অণু তৈরি করে। তার পর সেগুলি জমাট বেঁধে তৈরি করে আণবিক কঠিন অবস্থায় থাকা হাইড্রোজেন। যা তখন অপরিবাহী।

কিন্তু তার পর অনেক দিন এ ব্যাপারে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়নি। বলা যায়, তার গোড়াপত্তন হয় আজ থেকে ৫২ বছর আগে। ১৯৬৮-তে। যখন নিল অ্যাশক্রফ্‌ট পূর্বাভাস দেন অনেক বেশি তাপমাত্রাতেও ‘ধাতব হাইড্রোজেন’-এর মধ্যে অতিপরিবাহিতা ধর্মের হদিশ পাওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন- দার্জিলিঙের সকালে রজার আমাকে সৃষ্টির রূপ বোঝাতে শুরু করলেন​

আরও পড়ুন- ‘আমার তত্ত্বের ফাঁকফোকর খুঁজছি, তোমরাও খুঁজে দেখ’, এখনও বলেন জিম পিবল্‌স​

প্রতাপ ও অরিন্দম জানাচ্ছেন, অ্যাশক্রফ্‌টই প্রথম বলেন, বাইরে থেকে চাপ প্রয়োগ করা হলে হাইড্রোজেন অণুগুলির মধ্যেকার বন্ধন ভেঙে যায়। তখন কঠিন অবস্থায় থাকা হাইড্রোজেনের মধ্যে অতিপরিবাহিতা দেখা সম্ভব। অ্যাশক্রফ্‌ট এও বলেন, এই অতিপরিবাহিতা অনেক বেশি তাপমাত্রাতেও দেখা যাবে।

প্রতাপের বক্তব্য, এর পর ২০০২-’০৩ সালে জাপান ও আমেরিকার তিনটি গবেষকদল জানায় পর্যায় সারণীতে হাইড্রোজেনের ঠিক নীচে থাকা লিথিয়ামের উপর চাপ প্রয়োগ করা হলে তা ১৬ থেক ২০ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহী হয়ে ওঠে। এর পর ২০০৪-এ অ্যাশক্রফ্‌টই দেখান ধাতব হাইড্রোজেনের মধ্যে অতিপরিবাহিতার খোঁজ পেতে বিকল্প পথেও হাঁটা যেতে পারে। সেখানে হাইড্রোজেনেরও কোনও যৌগকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই প্রচেষ্টা প্রথম ফলবতী হয় ২০১৫ সালে। শূন্যের ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রা নীতে হাইড্রোজেন সালফাইডের মধ্যে অতিপরিবাহিতা দেখা সম্ভব হয়। তাতে বায়ুমণ্ডলের ১৫ লক্ষ গুঁ চাপ প্রয়োগ করতে হয়েছিল। তার পর গত বছর জার্মানি ও আমেরিকার দু’টি গবেষকদল জানায় ল্যান্থানাম ডেকাহাইড্রাইডের মধ্যেও এই অতিপরিবাহিতা পাওয়া গিয়েছে। শূন্যের নীচে মাত্র ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।

দু’টি হিরের খণ্ডের মধ্যে কার্বন, সিলিকন ও হাইড্রোজেনকে রেখে বাইরে থেকে চাপ দিয়ে এ বার ওই যৌগের মধ্যে অতিপরিবাহিতার সন্ধান মিলল ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায়। এই প্রথম।

গবেষকরা জানিয়েছেন, পদার্থটির মধ্যে মিথেন ও ট্রাই-হাইড্রোজেন সালফাইড রয়েছে প্রচুর পরিমাণে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন