প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডের সেই বাখশালী পুঁথি। সৌজন্যে: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
গোটা বিশ্ব এখন যে ভাবে চলে, প্রাচীন ভারত সেই পথে চলা শুরু করেছিল ১৭০০ বছর আগেই!
শূন্য বা জিরোর জন্ম অনেক আগেই হয়েছিল ভারতে। খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছরের মধ্যে। আর সেই শূন্যকে ‘ডট’ দিয়ে লেখা হত সেই সময়, যে ভাবে লেখা হয় আধুনিক গণিত ও বিজ্ঞানে।
আমরা ইংরেজি বাক্যে ‘ডট’ দিই বা বাক্যের শেষে ব্যবহার করি ‘ফুল স্টপ’। আধুনিক গণিতেও শূন্যকে ‘ডট’ দিয়ে লেখে গোটা বিশ্ব। আর ঠিক সেই ভাবেই সংখ্যার ভূবনের এই ‘ব্রহ্মা’- শূন্য বা জিরো লেখার চল ছিল প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডে, খ্রিস্টের জন্মের তিন শতকের মধ্যেই।
তা লেখা হত ভূর্জপত্রে। বার্চ গাছের ছাল বা বাকলকেই বলা হয় ভূর্জপত্র। প্রাচীন ভারত ভুখণ্ডের বাখশালী গ্রামে (অধুনা তা পাকিস্তানের পেশোয়ারে) পাওয়া একটি ভূর্জপত্রে মিলেছে তেমন ‘ডট’-এর হদিশ। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দাবি, বাখশিলা গ্রাম থেকে পাওয়া ওই ভূর্জপত্রটি ১৭০০/১৮০০ বছর আগেকার। খ্রিষ্টীয় তৃতীয়/ চতুর্থ শতকের। কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে ওই ভূর্জপত্রটির বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে বলে গবেষকদের দাবি।
আরও পড়ুন- পরমাণু বিদ্যুত্ নিয়ে ভয়টা অযথা, একান্ত সাক্ষাত্কারে পরমাণু শক্তি সচিব
আরও পড়ুন- ২০ বছরে টানা সাফল্যের পর কেন ‘ফেল’ করল ইসরো?
যে সংখ্যা নিয়ে এত অঙ্ক, পাটিগণিত, বীজগণিত, ক্যালকুলাস, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, নিউটন, আইনস্টাইনের যাবতীয় তত্ত্ব, সেই সংখ্যার ব্রহ্মাণ্ডে যে আদি ও অনন্ত, ‘কিং মেকার’, সেই শূন্য বা জিরোর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সংখ্যা-সাম্রাজ্যের যাবতীয় গূঢ় ও জটিল রহস্য। এর আগে জানা ছিল, খ্রিস্টীয় নবম শতকে শূন্যের জন্ম হয়েছিল প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বার্চ গাছের ছাল দিয়ে বানানো ওই ভূর্জপত্রগুলিকে বলা হয় ‘বাখশালী পুঁথি’। অধুনা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে পড়া বাখশালী গ্রাম থেকেই ওই পুঁথির প্রথম সন্ধান মেলে বলে গ্রামের নামেই নামকরণ হয়েছে ওই পুঁথির। ১৮৮১ সালে মাটি খুঁড়ে ওই পুঁথি উদ্ধার করা হয়। তার পর সেটিকে নিয়ে যাওয়া হয় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোদলেইয়ান লাইব্রেরিতে। ১৯০২ সাল থেকে সেই লাইব্রেরিতেই রয়েছে সেই বাখশালী পুঁথি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের বিশিষ্ট অধ্যাপক মার্কাস দু সতয় বলেছেন, ‘‘এই আবিষ্কার গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনাগুলির অন্যতম। এই প্রথম জানা গেল, খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকেই প্রাচীন ভারতে শূন্যের আবিষ্কার ও তার ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল, যা পরে আধুনিক পৃথিবীর যাবতীয় তাত্ত্বিক গবেষণার সবচেয়ে মৌলিক উপাদান বলে স্বীকৃত হয়েছে।’’
বাখশালী পুঁথিই যে প্রাচীন ভারতের গণিতচর্চার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও নিখুঁত প্রমাণ, তা আগেই জানা ছিল। কিন্তু তা এতটাই প্রাচীন যে তার বয়স আন্দাজ করাটা গবেষকদের পক্ষে আদৌ সহজ হচ্ছিল না। শেষমেশ কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানতে পেরেছেন ওই বাখশালী পুঁথি খ্রিষ্টীয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতকের। গবেষকরা জানিয়েছেন, যে পুঁথিগুলি তাঁরা হাতে পেয়েছেন সেগুলিতে শূন্য বোঝাতে হাজার হাজার ‘ডট’ লেখা রয়েছে। এটাই প্রমাণ করে প্রাচীন ভারতের বাখশালী আর তার আশপাশের এলাকায় শূন্যের কি বহুল ব্যবহার ছিল। অন্য কোনও সংখ্যার সঙ্গে শূন্যকে যোগ বা বিয়োগ করলে তার কোনও পরিবর্তন হয় না। গুণ করলে সেই সংখ্যাটা শূন্য হয়ে যায়। আর কোনও সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে তা অসীম হয়, এ সব জানা সত্ত্বেও বাখশালী পুঁথিতে শূন্যের বহুল ব্যবহার দেখে গবেষকদের এই বিশ্বাস আরও জোরালো হয়েছে, প্রাচীন ভারতের মানুষ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের চেয়ে অনেক আগেই গণিতশাস্ত্রে যথেষ্ট পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এর আগে প্রাচীন ভারতে শূন্যের ব্যবহারের যে প্রমাণ মিলেছিল, তা নবম শতকের। মধ্যপ্রদেশের গ্বালিয়রের একটি মন্দির গাত্রে সেই শূন্যের প্রতিকৃতি খোদাই করা ছিল। মায়া বা ব্যাবিলনীয় সভ্যতাতেও শূন্যের ব্যবহারের চল ছিল। কিন্তু এখন যে ভাবে গোটা বিশ্বে শূন্যকে ‘ডট’ দিয়ে বোঝানো হয়, তা যে প্রাচীন ভারতে অনেক দিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, বাখশালী পুঁথি তার সেরা প্রমাণ।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোদলেইয়ান লাইব্রেরির গ্রন্থাগারিক রিচার্ড ওভেনডেন বলেছেন, ‘‘গণিতশাস্ত্র ও প্রাচীন কালের দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এই আবিষ্কার একটি মাইলস্টোন। এই আবিষ্কার প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডের বিজ্ঞানচর্চার দীর্ঘ দিনের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে আরও জোরালো ভাবে প্রমাণ করল।’’
(এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয়েছিল, কোনও সংখ্যার সঙ্গে শূন্যকে গুণ করলে সেই সংখ্যার কোনও পরিবর্তন হয় না। এটা ভুল। সেই সংখ্যাটি তখন শূন্য হয়ে যায়। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য দুঃখিত। পাঠকদের ধন্যবাদ।)