এই অবস্থা থেকেও ফিরিয়ে আনতে পারবে বিজ্ঞান!

নিউরো-সায়েন্স ও মাইক্রো-বায়োলজির সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মানুষের হঠাৎ করে ‘ঘুমিয়ে পড়া’ মস্তিষ্ককে হয়তো এ বার জাগিয়ে তোলা যাবে। আর সে ক্ষেত্রে ‘সোনার কাঠি’ ছুঁইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া ‘রাজকন্যে’কে আবার যা ছুঁইয়ে আবার জাগিয়ে তোলা যেতে পারে, সেই ‘রুপোর কাঠি’র নাম কী, জানেন?

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৬ ১১:২২
Share:

জলজ্যান্ত মানুষটা অবোধ শিশুর মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন! তাঁর মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে! বহু পরিচিত কেউ সামনে এসে দাঁড়ালেও তাঁকে চিনতে পারেন না।

Advertisement

তবে তাঁর মুখটা হাঁ করিয়ে খাবার গুঁজে দিলে তিনি সেটা গপ্ করে গিলে নেন!

একেবারে সুস্থ, সবল হয়ে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেওয়ার পর হঠাৎই কেউ এমন হয়ে গিয়েছেন, এ তো আমাদের খুব একটা অজানা নয়।

Advertisement

‘বিদ্রোহী কবি’ নজরুলকে এক সময় আমরা এই ভাবেই ‘চির শান্ত’ হয়ে যেতে দেখেছি। দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় এই অবস্থাতেই পড়ে রয়েছেন ডাকাবুকো রাজনৈতিক নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। যেন অযান্ত্রিক!

নিউরো-সায়েন্স ও মাইক্রো-বায়োলজির সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, মানুষের হঠাৎ করে ‘ঘুমিয়ে পড়া’ মস্তিষ্ককে হয়তো এ বার জাগিয়ে তোলা যাবে। আর সে ক্ষেত্রে ‘সোনার কাঠি’ ছুঁইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া ‘রাজকন্যে’কে আবার যা ছুঁইয়ে আবার জাগিয়ে তোলা যেতে পারে, সেই ‘রুপোর কাঠি’র নাম কী, জানেন?

আরও পড়ুন- ৯ নম্বরই ‘লাস্ট স্টেশন’! সৌরমণ্ডলে আর কোনও গ্রহ থাকা সম্ভব নয়

বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য কি ভেদ হল এবার?

বিজ্ঞানের একেবারে হালের গবেষণার ফলাফল জানাচ্ছে, সেই ‘রুপোর কাঠি’র নাম- হাইড্রা। ওই এককোষী জলজ প্রাণীর এপিথেলিয়াল কোষেই রয়েছে ‘ঘুমিয়ে পড়া’ মস্তিষ্কের ‘জিয়নকাঠি’!

গবেষক দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন সুইৎজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউনিজে) ডিপার্টমেন্ট অফ জেনেটিক্স অ্যান্ড এভোলিউশানের অধ্যাপক ব্রিজিট গালিয়ট, জিন-তাত্ত্বিক ভান ওয়েঙ্গার ও বিবর্তন তত্ত্ববিদ ওয়ান্ডা বুজগারিয়ু। ‘লস অফ নিউরোজেনেসিস ইন হাইড্রা লিডস্ টু কমপেনসেটারি রেগুলেশান অফ নিউরোজেনিক অ্যান্ড নিউরোট্রান্সমিশান জিনস ইন এপিথেলিয়াল সেল্‌স’ নামে তাঁদের ওই গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি বেরিয়েছে ‘ফিলোজফিক্যাল ট্রানজাকশান্স অফ দ্য রয়্যাল সোসাইটি’ জার্নালে।

যাকে বলে ‘অসাধ্য সাধন’, তা কী ভাবে সম্ভব করে তোলা যাবে?

সহযোগী গবেষক, নেদারল্যান্ডসের রাবাউন্ড ইউনিভার্সিটি নিমেজেনের জিনতত্ত্ববিদ ঊর্মিমালা মিশ্রের ব্যাখ্যায়, ‘‘এটার জন্য বুঝতে হবে হাইড্রা কী ধরনের এককোষী অণুজীব? হাইড্রা এমনই একটি বিরল গোত্রের এককোষী অণুজীব, যাদের কার্যত মৃত্যু নেই! তাদের শরীরের কোনও একটি অংশ, এমনকী, তাদের যেটা ‘মাথা’, সেটাকেও যদি কেটে ফেলা হয়, তা হলেও তাদের মৃত্যু হয় না। তাদের শরীরে আবার সেই অঙ্গটি গজিয়ে ওঠে। আড়াইশো বছরেরও বেশি আগে সুইস পরিবেশবিদ আব্রাহাম ট্রেম্বলিই প্রথম হাইড্রার এই অপরিসীম ক্ষমতার কথা জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু কী ভাবে এই কাজটা করতে পারে হাইড্রা? তার কোনও উত্তর গত তিন শতাব্দীতে পাওয়া যায়নি। আমাদের গবেষণায় যেটা বেরিয়ে এসেছে, তা হল- হাইড্রার স্নায়ুতন্ত্রই তাদের বিভিন্ন আচরণ আর চালচলনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। কী ভাবে হাইড্রারা এগোবে বা জলে ‘সাঁতার’ কাটবে, সব কিছুই ঠিক করে দেয় তাদের স্নায়ুতন্ত্র। আমরা যেটা অবাক হয়ে দেখেছি, সেটা হল- যে স্টেম সেলগুলোর


শিল্পীর কল্পনায় আমাদের মস্তিষ্ক।

জন্য হাইড্রারা ‘কাটা মুন্ড’ হলেও, তাদের সেই অঙ্গ আবার তৈরি করে নিতে পারে, সেই স্টেম সেলগুলোকেও যদি তাদের শরীর থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়, তা হলেও হাইড্রাদের ‘পুনর্জাগরণে’ কোনও অসুবিধাই হয় না। তারা তখনও কার্যত, মৃত্যুহীনই থাকে! এমনকী, তাদের স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইউনিট ‘নিউরন’গুলোকেও যদি তাদের শরীর থেকে কোনও ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া যায়, তা হলেও তারা মরে যায় না। এমনকী, অবশ বা নিথর অথবা অযান্ত্রিকও হয়ে পড়ে না! তারা আবার সেই নিউরনগুলোকে তাদের শরীরে গজিয়ে নিতে পারে।’’

এই অসাধ্য সাধনটা কী ভাবে করতে পারে হাইড্রা?

আরও এক সহযোগী গবেষক, সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনতাত্ত্বিক মেঘনা শ্রীবাস্তব বলছেন, ‘‘আমরা সেই কারণটাই খুঁজে পেয়েছি। গবেষণায় দেখেছি, হাইড্রার শরীরের একেবারে বাইরের স্তরে যে বিশেষ ধরনের কোষ আর কলা থাকে (এপিথেলিয়াল কোষ), সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী অন্তত ২৫টি জিন আমরা খুঁজে পেয়েছি। এই জিনগুলো কখনও হাইড্রার নষ্ট হয়ে যাওয়া নিউরনের নতুন বিকল্প নিউরন তৈরি করে। যাকে বলে, ‘নিউরো-জেনেসিস’। কখনও-বা ওই জিনগুলো প্রয়োজনে হাইড্রাদের নিউরনের কাজকর্মগুলোকেও বদলে দিতে পারে। যাকে বলে, ‘নিউরো-ট্রান্সমিশান’। মানে, নষ্ট হয়ে যাওয়া নিউরন হাইড্রাদের স্নায়ুতন্ত্রের যে

আমাদের মস্তিষ্কের নষ্ট হয়ে যাওয়া নিউরন (লাল চিহ্নিত)।

কাজটা করত, তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে অন্য একটি নিউরনকে দিয়ে সেই কাজটাই সাময়িক ভাবে করিয়ে নিতে পারে হাইড্রাদের ওই ২৫টি বিশেষ জিন। হাইড্রাদের নিউরনগুলো নষ্ট হয়ে গেলে, তাদের এপিথেলিয়াল কোষগুলো স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই বিশেষ ধরনের ওই ২৫টি জিনের কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দেয় যে, ‘এ বার তোমাদের তৎপর হয়ে উঠতে হবে। নষ্ট বা লুপ্ত হয়ে যাওয়া নিউরনগুলোর জন্য যাতে হাইড্রা অবশ বা নিথর অথবা অযান্ত্রিক হয়ে না পড়ে, তার আপৎকানীল ব্যবস্থাটা তোমাদেরই নিতে হবে।’ যেমন বলা, তেমন কাজ। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ে হাইড্রার শরীরের ওই লড়াকু ২৫টি জিন। তাদের তৎপরতাতেই হাইড্রা আবার ঝকঝকে তকতকে নতুন নিউরন পেয়ে যায়। তার নতুন নতুন অঙ্গ পেয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থেই যা, ‘পুনর্জাগরণ’ বা ‘রেজারেকশান’!’’

স্মৃতিভ্রংশ মানুষকেও কি এ ভাবে ছন্দে ফেরানো যাবে?

এই ‘রেজারেকশান’ কি কাজী নজরুল বা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মতো স্মৃতিভ্রংশ মানুষের ক্ষেত্রেও সম্ভব হবে কোনও দিন?

ঊর্মিমালার জবাব, ‘‘এটা আসলে ‘রিভার্স এভোলিউশান’। যেন ‘উল্টোরথের পথ’! এককোষী থেকে বহুকোষী হওয়া মানে তো উত্তরণ। তা হলে পুনর্জাগরণের ক্ষমতা যদি সামান্য একটা এককোষী অণুজীবের থেকে থাকে, তা হলে তা উন্নততর বহুকোষী জীবে কেন বর্তানো সম্ভব হবে না? জিন-তত্ত্ব কখনওই বলে না, এই উল্টোরথের পথে হাঁটা যাবে না।’’

রথ দেখা তো হল!

উল্টোরথের পথেও হাঁটা শুরু হতে আর ক’দিনই বা বাকি আছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন