কৃষ্ণগহ্বর অত কালো নয়, তিনিই বলেছিলেন

স্টিফেন হকিং আবিষ্কারের প্রথম ধাক্কায় নিজেই একটু লজ্জা বোধ করেছিলেন— মনে হয়েছিল তাঁর অঙ্কে বোধহয় ভুল আছে। এক রাত্রে, বিছানায় ঢোকার আগে হঠাত্ মাথায় আবিষ্কারের বিদ্যুত্ ঝলক খেলে গেল, ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত।

Advertisement

বিকাশ সিংহ

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৮ ১৭:৫৮
Share:

রাতারাতি প্রায় পদার্থবিদ্যার জগতে হকিংয়ের আবিষ্কার যেন ভূমিকম্প— কৃষ্ণগহ্বর কি স্বচ্ছগহ্বর হল না কি?

অধ্যাপক স্টিফেন হকিংয়ের যুগান্তকারী আবিষ্কার, ‘কৃষ্ণ গহ্বর বিকিরণ করে’। পদার্থবিদরা এই আবিষ্কারের কথাটা জানতে পারেন ১৯৭৪ সালে। রাতারাতি প্রায় পদার্থবিদ্যার জগতে এই আবিষ্কার যেন ভূমিকম্প— কৃষ্ণগহ্বর কি স্বচ্ছগহ্বর হল না কি? এই সব আজগুবি প্রশ্ন মানুষের মনে আসে। স্টিফেন হকিং আবিষ্কারের প্রথম ধাক্কায় নিজেই একটু লজ্জা বোধ করেছিলেন— মনে হয়েছিল তাঁর অঙ্কে বোধহয় ভুল আছে। এক রাত্রে, বিছানায় ঢোকার আগে হঠাত্ মাথায় আবিষ্কারের বিদ্যুত্ ঝলক খেলে গেল, ‘ইউরেকা’ মুহূর্ত। “না ঠিকই আছে”— বিকিরণটা আসছে ওই কৃষ্ণগহ্বর থেকেই, ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যায় সেটা বোঝা যাবে না, কোয়ান্টাম তত্ত্ব লাগাতে হবে। যে কোনও পদার্থ বা বিকিরণ কৃষ্ণগহ্বর গ্রাস করার সময়ে তার বিপরীত বিকিরণই বাস্তব বিকিরণ এই কৃষ্ণগহ্বর থেকেই ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। স্টিফেন নিজেই বলেছেন এবং সেই কথাটি তাঁর মেকানিকাল গলায় শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আগে, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স অ্যান্ড থিয়োরিটিক্যাল ফিজিক্সের একটি উত্সবে, কেমব্রিজে।

Advertisement

ওঁর চরিত্রের মধ্যে একটা দুষ্টু বালকের প্রবণতা ছিল, নেপথ্যে উনি বলে উঠলেন, “ইটস বেটার দ্যান সেক্স।” কিন্তু হকিং রেডিয়েশন এতই ক্ষীণ, যে সেটা হাতে কলমে আজও আবিষ্কার হয়ে ওঠেনি এবং সেই জন্যই স্টিফেন নোবেল প্রাইজ পাননি। নোবেলের উইলে পরিষ্কার লেখা আছে যে, পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার যদি পরীক্ষা নিরীক্ষায় প্রমাণ করা যায়, তা হলেই তাঁকে প্রাইজ দেওয়া হবে।

এই আবিষ্কারের বেশ কয়েক বছর আগেই আইনস্টাইনের ‘জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ সমীকরণ সমাধান করে আবিষ্কার হয়েছিল ‘পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি’, যেখানে না আছে ‘স্থান’ না আছে ‘কাল’, কেবল মাত্র বিন্দু।

Advertisement

আরও পড়ুন:

বিজ্ঞানের ঈশ্বরকে আমি কাছ থেকে পেয়েছি

মুম্বইয়ের সেই সন্ধ্যা, ছাঁইয়া ছাঁইয়ায় দুলে চলেছেন তিনি...

কেমব্রিজে ছাত্র অবস্থায় তখন আমি, স্টিফেন হকিংয়ের আবির্ভাব হল অক্সফোর্ড থেকে, পরনে স্টাইলের জামাকাপড়, বো টাই, কর্ডুরয় প্যান্টুলুন আর কোট, অনেকটা চিত্রতারকার মতো। কিন্তু এই মানুষটির মধ্যে যে এক যুগান্তকারী প্রতিভার মশাল জ্বলছে সেটা আমরা, ছাত্ররা অন্তত বুঝতে পারিনি। উনি তখন অধ্যাপক সিয়ামার সঙ্গে গবেষণা করতেন। অধ্যাপক সিয়ামা আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। নিপুণ শিক্ষক, প্রাঞ্জল ভাষা। তখন কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি স্টিফেনকে ওপর ওপরই চিনতাম। হৃদ্যতা বা অন্তরঙ্গতার কোনও সুযোগ হয়নি।

স্টিফেন হকিং জানিয়েছিলেন কৃষ্ণগহ্বরের রহস্য। ছবি:নাসার সৌজন্যে।

১৯৭৪ সালে আমি তখন ক্যাল টেকে, কয়েক মাসের জন্য গিয়েছিলাম, দেশে ফিরে আসার আগে। সেখানে দুই তারকার বাস। এক জন রিচার্ড ফাইনম্যান, আর এক জন মারে গেল ম্যাল। দু’জনেই জগতপ্রসিদ্ধ, তবে ফাইনম্যানের নামডাক অনেক বেশি। সুপুরুষ, জ্বলজ্বলে চোখ, বোর্ডে চক দিয়ে পড়াতেন। তাঁরই অতিথি ছিলেন স্টিফেন হকিং। তখন থেকেই হুইল চেয়ারে। একটি চৌখস যুবক (ছাত্র) ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেত। যত দূর মনে আছে, অধ্যাপক কিপ থর্নের আহ্বানে স্টিফেন ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাল টেকে (প্যাসাডিনা) এসেছিলেন। তখনই স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে ভাল করে আলাপ হয়। কথাবার্তা চেষ্টা করে বোঝা যেত তখন। মনে রাখবেন সেটা ১৯৭৪ সাল, স্টিফেন হকিংয়ের কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ তখনও পদার্থবিদ্যার জগতকে কাঁপাচ্ছে।

তারপর বহু দিন দেখা হয়নি। শেষ দেখা হয়েছিল ওই ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স এবং থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সের উত্সবের সন্ধ্যায় নৈশভোজ উপলক্ষে কেমব্রিজের কিঙ্গস কলেজে। ভোজের শেষে ওঁর টেবিলের কাছে সাহস করে গেছিলুম। টেবিলের শেষের দিকে হুইল চেয়ারে আধ শোয়া। কথা বলতে পারতেন না, চোখের ইশারা থেকে কম্পিউটার বুঝতে পারত কী বলার চেষ্টা করছেন। খুব ধীরে ১৯৭৪ সালের কথাটা তুললাম। অনেক ক্ষণ চেষ্টা করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন— “সে তো বহু কাল আগে।” বেরিয়ে এসে খোলা আকাশের তলায় আমার একটি ভাবনা এল মনে। এই বিরাট আবিষ্কারের সঙ্গে ‘কাল’-এর কি কোনও সম্পর্ক আছে? মনটা একটু আচ্ছন্নই হল বটে।

আর একটি বিরাট এবং কঠিন কাজ স্টিফেন হকিং করেছিলেন। সেটা হল ওই বইটি লেখা— ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’। সময়ের তো আদিও নেই, অন্তও নেই। তা হলে ‘ব্রিফ’ কেন? আমার মনে হয়, উনি বোঝাবার চেষ্টা করছেন যে, অনন্ত কালের মতো আমাদের জীবিত কাল তো ক্ষণস্থায়ীই।

যেটুকু জেনেছি বা বুঝেছি, তাতে এই মনে হয়, আজকে, যে এই কঠিন রোগকে জয় করে জ্ঞানের ভান্ডারে যে ওঁর দান, সেটা আজ থেকে বহু বছর পরেও ম্লান হবে না। যেমন হবে না নিউটন, আইনস্টাইনের মতো বহু মহা চিন্তাশীল মানুষগুলির। স্টিফেন হকিংয়ের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর সব চেয়ে উপযুক্ত কাজ হবে এই ‘দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ পড়া। কেবল বইয়ের আলমারিতে সাজিয়ে রাখলে চলবে না।

(লেখক আইএনএসএ-র এমেরিটাস বিজ্ঞানী, ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জির প্রাক্তন হোমি ভাবা অধ্যাপক, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স অ্যান্ড ভ্যারিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টারের প্রাক্তন অধিকর্তা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন