গবেষণাগারে বানানো মিড ব্রেন।
আমরা কি এগিয়ে চলেছি ‘হীরক রাজা’র মর্জিমাফিক? ‘হীরক রাজা’ যেমনটি চেয়েছিলেন, এত দিন পর প্রায় সেটাই করে ফেলা গেল!
নিজেদের ‘ব্রেন’ মানে মগজ বানিয়ে ফেলল মানুষ! গবেষণাগারে। এই প্রথম।
যে ‘ব্রেন’ আমাদের চালায়, কোনও শব্দ শুনতে সাহায্য করে, চোখের মণিকে বিভিন্ন দিকে ঘোরাতে সাহায্য করে, নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের দৃষ্টিশক্তি, বলে দেয়, এগোতে গেলে পা দু’টোকে কখন, কোথায়, কতটা দূরে ফেলতে হবে, খেতে গেলে ডান হাতটাকে কী ভাবে চালাতে হবে। এটাকেই আমাদের মগজের ‘মধ্যাঞ্চল’ বা ‘মিড ব্রেন’ বলা হয়।
আমাদের মগজের এই মধ্যাঞ্চলেই রয়েছে সেই সুবিশাল ‘সুপার-হাইওয়ে’। অত্যন্ত প্রশস্ত, মোলায়েম, সূদীর্ঘ সেই ‘সুপার-হাইওয়ে’ দিয়ে আলোর গতিতে ছোটাছুটি করে একের পর এক তথ্য বা ইনফর্মেশন। এ মাথা থেকে ও মাথায়। তাই আমাদের মগজের এই অংশটির নাম- ‘ইনফর্মেশন সুপার-হাইওয়ে’। গবেষণাগারে এই প্রথম সেই ‘সুপার-হাইওয়ে’টিকে বানিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে।
এই সেই ‘হাতে গড়া’ মিড ব্রেন। কালো পিগমেন্টই নিউরোমেলানিন।
সিঙ্গাপুরের ‘হীরক রাজ্যে’র এই গবেষণাটি এখন গোটা বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ‘জিনোম ইনস্টিটিউট অফ সিঙ্গাপুর’ (জিআইএস)-এর জিনতত্ত্ববিদ নগ হুক হুই এবং ডিউক-নুস মেডিক্যাল স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিউরো-সায়েন্টিস্ট শাওন জে’র নেতৃত্বে ওই গবেষকদলে বড় ভূমিকা রয়েছে এক বাঙালি মহিলার। তিনি আমেরিকার জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর উজ্জয়িনী মিত্র।
কী করেছেন গবেষকরা?
গবেষকদলের সদস্য ‘বাংলার মুখ’ উজ্জয়িনী মিত্র (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়)
উজ্জয়িনী বলছেন, ‘‘স্টেম সেল দিয়ে আমাদের মগজের মধ্যাঞ্চলের (মিড ব্রেন) কোষ-কলাগুলিকে কৃত্রিম ভাবে বানানো হয়েছে গবেষণাগারে। যেগুলোকে বলে ‘ব্রেন অরগ্যানয়েড্স’। যা লম্বায় বড়জোর দুই থেকে তিন মিলিমিটার। অনেকটা পেন্সিল ইরেজারের মতো। বা গর্ভাবস্থায় পাঁচ সপ্তাহের ভ্রুণের সাইজ যতটা হয়, ততটাই। এই বানানো ‘মিড ব্রেন’টাও আমাদের মগজের মতোই ত্রিমাত্রিক। মানে, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা, তিনটেই রয়েছে। রয়েছে থাকে থাকে সাজানো বিভিন্ন স্তর। রয়েছে স্নায়ুতন্তু বা নিউরন আর ‘নিউরো-মেলানিন’। এই ‘নিউরো-মেলানিন’ আদতে কালো রঙের একটা পিগমেন্ট।’’
এতে সুবিধাটা কী হবে আমাদের?
আরও পড়ুন- গরুর দুধের চার গুণ পুষ্টি আরশোলার দুধে!
‘জিনোম ইনস্টিটিউট অফ সিঙ্গাপুর’ (জিআইএস)-এর জিনতত্ত্ববিদ নগ হুক হুই ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘বাজারে চালু ওযুধগুলি মগজের ওই অংশে কী ভাবে কাজ করে, এই প্রথম সেটা আমরা চাক্ষুষ করতে পারব। রোগীদের দেওয়ার আগে নতুন বা সদ্য-আবিষ্কৃত ওষুধগুলিকে পরীক্ষা করে নিতে পারব। দেখে নিতে পারব মগজের মধ্যাঞ্চলে সেগুলি কী ভাবে কাজ করতে পারে। এর ফলে, পারকিনসন্স ডিজিজের মতো মস্তিষ্কের বেশ কয়েকটি সুজটিল অসুখের কিনারা করতে আমাদের সুবিধা হবে। এই মুহূর্তে বিশ্বে ফি-বছর পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হচ্ছেন ৭০ লক্ষ থেকে এক কোটি মানুষ।’’
কেন কৃত্রিম ভাবে বানানো আমাদের মগজের এই মধ্যাঞ্চলটি পারকিনসন্স ডিজিজের মতো মস্তিষ্কের সুজটিল অসুখগুলির কারণ জানতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা?
মূল গবেষক নিউরো-সায়েন্টিস্ট শাওন জে।
ডিউক-নুস মেডিক্যাল স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নিউরো-সায়েন্টিস্ট শাওন জে’র কথায়, ‘‘আমাদের মগজের এই ‘মিড ব্রেন’ অংশটিতেই থাকে যাবতীয় কাজকর্মের নিয়ন্ত্রক কালো রঙের পিগমেন্ট ‘নিউরো-মেলানিন’। আর রয়েছে সেই নিউরনগুলো, যেখান থেকে বেরিয়ে আসে ‘ডোপামাইন’। এই ডোপামাইনের ক্ষরণ যদি বেশি হয়, তা হলে তা আমাদের অনেক বেশি ক্ষিপ্র করে তোলে, আমাদের রিফ্লেক্স অ্যাকশন বা প্রতিবর্তী ক্রিয়ার গতি বাড়ায়। আমাদের চনমনে, চঞ্চল রাখে। আবার ডোপামাইনের বেশি ক্ষরণ হলে যে কোনও ঘটনাতেই চট করে আমাদের চোখে জল এসে যায়। খুব সহজেই আমরা আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়ি। আর তার ক্ষরণের পরিমাণ কমে গেলে পারকিনসন্স ডিজিজের মতো মস্তিষ্কের জটিল অসুখগুলি হয় আর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হাত, পা শক্ত হয়ে যায়। হাত, পা নাড়াতে অসুবিধা হয়। আর নিউরো-মেলানিনের ঘাটতি হলে আমাদের হাত, পা কাঁপে। এই বিষয়গুলিকে পর্যবেক্ষণের জন্য এত দিন ইঁদুর, খরগোশ, বেড়ালের মতো প্রাণীদের ব্যবহার করা হোত। এখনও করা হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মগজ ওই মনুষ্যেতর প্রাণীদের চেয়ে আলাদা। তাই কৃত্রিম ভাবে গবেষণাগারে বানানো ওই মিড ব্রেন এ বার আমাদের কাজটা অনেকটাই সহজ করে দেবে।’’
তবে ‘হীরক রাজা’ যেমনটি চেয়েছিলেন, সেই ‘ব্রেন ওয়াশ’-এর রাস্তাটাও, এর ফলে, খুলে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে! কারণ, তা হলে তো ওষুধ প্রয়োগ করে আমাদের মগজের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটির ওপর ‘যেমন ইচ্ছে, কারিকুরি’ করা যাবে!
জন্মসূত্রে কলকাতার কন্যা হলেও পুরোপুরি আমেরিকা-প্রবাসী উজ্জয়িনী বলছেন, ‘‘সে জন্যই গবেষণাগারে বানানো এই মিড ব্রেন শুধুই গবেষণায় কাজে লাগানো হবে। আর সেই সব কাজই করা হবে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি মেনে। আন্তর্জাতিক তদারকিতে।’’
ছবি ও তথ্য সহায়তা: জিনোম ইনস্টিটিউট অফ সিঙ্গাপুর’ (জিআইএস) ও ডিউক-নুস মেডিক্যাল স্কুল, সিঙ্গাপুর।