ইওশিনোরি ওসুমি
সব কি ফেলে দেওয়া যায়? ফেলে দেওয়া কত জিনিসই তো অন্য নানা কাজে লেগে যায়। হরলিক্সের শিশিতে ঘি থাকে। ডাবরের ছোট কৌটোয় মশলা রাখা শুরু হয়। এত গেল সংসারের নিত্য দিনের পুনর্ব্যবহারের উদাহরণ। আমাদের, মানে এই জীবজগতের কোষের মধ্যেও এই পুনর্ব্যবহারের প্রচলন আছে। পোশাকি নাম ‘অটোফাজি’।
দু’টি গ্রিক শব্দের সম্বন্বয়ে তৈরি হয়েছে ‘অটোফাজি’ শব্দটি। ‘অটো’ মানে নিজের থেকে। আর ‘ফাজেইন’র বাংলা দাঁড়ায় খাওয়া। কোষের মধ্যে নিজেকেই নিজে খেয়ে নেওয়ার পদ্ধতিটি অটোফাজি। এই আত্মভক্ষণ কিন্তু কোষের ক্ষতি করে না। বরং কোষকে সজীব রাখতে সাহায্য করে। আর এই আত্মভক্ষণে কোনও সমস্যা হলেই পার্কিনসন্স, ক্যানসার, টাইপ-২ ডায়াবেটিস-এর মতো নানা রোগের উৎপত্তি হতে পারে। এই আত্মভক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেই ২০১৬-এর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন জাপানের বিজ্ঞানী ইওশিনোরি ওসুমি। এ বাবদ ৮০ লক্ষ সুইস ক্রোনার বা সাত লক্ষ ১৮ হাজার ডলার মিলবে তাঁর।
আত্মভক্ষণ বলা সহজ। কিন্তু, অতি জটিল একটি প্রক্রিয়া। ১৯৬০-এর দশকে প্রথম এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়। কী ভাবে কোষ তার নিজের অপ্রয়োজনীয় অংশ নিজেই ধ্বংস করে ফেলছে তা নিয়ে ধারণা ছিল। প্রথমে কোষ অপ্রয়োজনীয় অংশটির চারপাশ মেমব্রেন বা পর্দা দিয়ে ঘিরে ফেলে থলির মতো তৈরি করে। তার পরে থলিগুলি ভাসতে ভাসতে কোষের পুনর্ব্যবহারের কারখানা ‘লিসোজোমে’ চলে যায়। তার পরে উৎসেচক ধ্বংসের কাজ চালায়। এতে কোষগুলি বর্জ্যমুক্ত হয়ে সজীব হয়। কিন্তু এই ঘটনাটিকে চাক্ষুষ করা খুব শক্ত। ফলে ৯০’-এর দশকের আগে পর্যন্ত ঘটনাটি প্রমাণ করা যায়নি। জাপানে নিজের গবেষণাগারে ‘ইস্ট’-এর কোষে প্রথম ইওশিনোরি ওসুমি এই প্রক্রিয়াটির জন্য দায়ী জিনকে চিহ্নিত করেন। পরে ইস্টে কী ভাবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় তা দেখান। তার পরে মানবদেহের কোষেও এই জটিল প্রক্রিয়াটি কী ভাবে হয় তাও ব্যাখ্যা করেন।
‘‘আমি বিশেষ প্রতিযোগিতায় সামিল হতে তাই না। তাই নতুন বিষয় খুঁজি। বিষয়টি বিজ্ঞানের জগতে সে ভাবে জনপ্রিয় না হলেও।’’, ২০১২-এ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন ইওশিনোরি ওসুমি। যখন কাজটি শুরু করেছিলাম তখন এটা নিয়ে বিশেষ চর্চা হত না। নানা বিষয় নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই আত্মভক্ষণ পদ্ধতিটি বিশদে জানাতে আগ্রহ জাগে ইওশিনোরি ওসুমি। ১৯৮৮-তে নিজের গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার পরে এ বিষয়ে নজর দেন। এবং এই কাজের জন্য ইস্টের কোষ বেছে নেন। ইস্টের কোষ অনেকটা মানব কোষের মতো। পাশাপাশি ইস্টের কোষে জিনগুলি সহজে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু ইস্টের কোষ এতই ছোট যে তাতে এই প্রক্রিয়াটি অতি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের তলায়ও দেখা যায় না।
তাই ঘুরপথে এগোলেন ওসুমি। তিনি আত্মভক্ষণের প্রক্রিয়াটিকেই বিগড়ে দিলেন। কারখানার মধ্যে যে উৎসেচক প্রক্রিয়াটিকে সম্পন্ন করে তাকে সরিয়ে নিলেন। ফলও মিলল। দেখলেন কারখানা ছোট ছোট থলিতে ভরে গিয়েছে। এই প্রথম ঘুরপথে আত্মভক্ষণের প্রমাণ পেলেন ওসুমি। ১৯৯২-এ এ নিয়ে গবেষণাপত্র বার করেন। এর এক বছরের মধ্যেই এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রথম জিনটির হদিশও পেয়ে যান ওসুমি। এর পরে বাকিটা ইতিহাস।
ইওশিনোরি ওসুমি-র এই আবিষ্কার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। দেখা গিয়েছে সব কোষেই এই প্রক্রিয়া চলছে। এ ভাবেই কোষগুলি নিজের পুনর্গঠনের শক্তি সঞ্চয় করে। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাস কোষের মধ্যে ঢুকলে ধ্বংস হয়ে যায়। কোনও কারণে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটলে পার্কিনসন্স থেকে ক্যানসার, বা জিনঘটিত জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এই নিয়ে গবেষণা এ সব রোগের নুতন ওষুধ তৈরিতেও সাহায্য করছে।
আরও পড়ুন- আপনি আর ‘লিও’ নন, নন ‘ভার্গো’ও, বদলে গেল ভাগ্যচক্র
আরও পড়ুন- বাঙালির দুর্গাপুজো, নতুন রূপে নতুন সাজে
আরও খবর- থিমের সাজে অচেনা কলকাতা