কৃষ্ণ গহ্বরের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য অন্য তলে?
একটা পিঁপড়ে হেঁটে চলেছে মাটির ওপরে। সমতলে। সমতলের দু’টি মাত্রা। দৈর্ঘ্য আর প্রস্থ। ওই দু’টি মাত্রা নিয়েই পিঁপড়েটার জগৎ। সে জানতেও পারে না, তার মাথার ওপরে রয়েছে কতই না সু্ন্দর আকাশ, গাছপালা, সাগর-মহাসাগর, আরও কত কী! ওই সব কিছুই পিঁপড়েটার কাছে অজানা থেকে যায়।
এ তো গেল পিঁপড়ের কথা।
আমরা থাকি একটা তিন মাত্রার জগতে। যাকে বলা হয়, ‘থ্রি-ডাইমেনশনাল’। যার তিনটি দিক বা মাত্রা রয়েছে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা।
কিন্তু আমরাও কি ওই পিঁপড়েটার মতো?
আমাদের চোখেও কি ধরা পড়ে না নতুন আরও একটি দিক বা, মাত্রা? যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক অজানা দেশের রহস্য।
ঠিক ওই রকম এক অজানা জগতের সম্ভাবনার কথা আমাদের শুনিয়েছিলেন জার্মান বিজ্ঞানী থিওডর কালুজা ও সুইডিশ বিজ্ঞানী অস্কার ক্লিন। তার কয়েক বছর আগে, ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বা General Relativity-র সাহায্যে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে, মহাকর্ষ বল বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স’ আসলে আমাদের এই ত্রিমাত্রিক দেশ (Space) ও কালের (Time) বক্রতা (Curvature) থেকেই তৈরি হয়।
তাঁর এই সাড়াজাগানো আবিষ্কারের পরে গত শতাব্দীর কুড়ির দশকে বিজ্ঞানী কালুজা ও ক্লিন দেখালেন যে, আমরা যদি আমাদের তিন মাত্রিক জগতের সঙ্গে বাড়তি একটি দিক বা মাত্রার অস্তিত্ব ধরে নিই, তা হলে আমাদের অতি পরিচিত তড়িৎ-চুম্বকীয় বলকেও একই ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি।
আরও পড়ুন:
নতুন কণার ইঙ্গিত মিলল সার্ন-এ
আঁধার কণাদের ধরতে চালু মডেল ছেড়ে বেরোতে চান পদার্থবিদরা
এর অনেক দশক পরে ‘স্ট্রিং থিয়োরি’ এই রকম বাড়তি আরও অনেক দিক বা মাত্রার অস্তিত্বের কথা তুলে ধরে।
প্রশ্ন ওঠে, ওই ‘অজানা’ দিক বা মাত্রাগুলো যদি থেকেই থাকে, তা হলে আমরা তাদের দেখতে পাই না কেন?
এর একটি সম্ভাব্য কারণ হল, ওই দিকগুলো আমাদের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতার মতো ছড়ানো নয়। সেগুলো অনেকটা ছোট ছোট বৃত্তের মতো দেখতে। এর মানেটা হল, আমাদের এই তিন মাত্রা বা দিকের জগতের প্রত্যেক বিন্দুতে রয়েছে একাধিক বৃত্ত দিয়ে তৈরি এক ‘অজানা জগৎ’।
ব্রহ্মাণ্ড (নীল সরলরেখা) আর তার লুকনো তল (গোলাকার)
সেই বৃত্তগুলো এতটাই ছোট যে, খালি চোখে আমরা সেগুলি দেখতে পারি না। যেমন, পিঁপড়েটা তার মাথার ওপর আকাশ, গাছপালার কিছুই দেখতে পায় না। ওই ছোট ছোট বৃত্তগুলোর মধ্যে ঢুকতে গেলে দরকার অত্যন্ত উচ্চশক্তির তরঙ্গ। তারই জন্য সুইজারল্যান্ডের জেনিভা শহরে বানানো হল একটি সর্বাধুনিক যন্ত্র-‘লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার’ বা, এলএইচসি। সেই যন্ত্রের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ শক্তিতে প্রোটন কণার স্রোতের মধ্যে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ ঘটিয়ে ‘অজানা দেশে’র খোঁজে পাড়ি দেওয়া শুরু হল।
সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। জেনিভায়।
বিস্ময়ের ব্যাপার হল এটাই যে, যদি সত্যি-সত্যিই ওই বাড়তি দিক বা, মাত্রাগুলো থাকে, তা হলে দু’টো নতুন ঘটনা ঘটবে। যা, আমরা আমাদের এই তিন মাত্রা বা দিকের জগতে বসেই দেখতে পারব।
সেগুলি কী কী?
এক, কিছু নতুন কণার সৃষ্টি হবে, যেগুলি আমাদের জগতে নানা রকম প্রভাব ফেলবে। ওই কণাগুলির নাম দেওয়া হয়েছে- ‘কালুজা-ক্লিন কণা’।
দুই, ওই অজানা দেশের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল এতটাই শক্তিশালী হবে যে, তার থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ‘Black Hole’ বা, কৃষ্ণ গহ্বরের জন্ম হতে পারে। যেগুলি প্রোটন কণার মতো ছোট। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং দেখালেন, ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কৃষ্ণ গহ্বরগুলোর ভেতর থেকে নানা রকমের কণার স্রোত, এমনকী, আলোর স্রোতও বেরিয়ে আসতে পারে। যেহেতু আলো বেরিয়ে আসতে পারছে, তাই ওই কৃষ্ণ গহ্বরগুলোকে আদৌ ‘Black’ বা কৃষ্ণ বলা যাবে না। এই ব্যাপারটারই নাম দেওয়া হল- ‘হকিং বিকিরণ’ বা ‘Hawking Radiation’।
কৃষ্ণ গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা ‘হকিং বিকিরণ’। শিল্পীর কল্পনায়।
সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে ওই ‘কালুজা-ক্লিন কণা’ ও ‘হকিং বিকিরণ’-এই দুইয়েরই জোর খোঁজ-তল্লাশ চলছে। যদি সেগুলির হদিশ মেলে শেষ পর্যন্ত, তা হলে আমাদের তিন মাত্রা বা দিকের জগতের বাইরে একটি নতুন জগতের দরজা খুলে যাবে। যেখানে বহু অজানা রহস্যের উন্মোচন হবে।
ওই পিঁপড়েটার মতো মাথা গুঁজে শুধুই সমতলে না হেঁটে আমরা কিন্তু সত্যি-সত্যিই উড়ে যেতে চাই সেই ‘অজানা দেশের’ সন্ধানে।
যেখানে আজ হোক বা কাল, আমরা ঠিকই পৌঁছে যাব!
লেখক সিনিয়র প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অফ থিয়োরেটিক্যাল ফিজিক্স এবং
ডিন (অ্যাকাডেমিক), ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশান অফ সায়েন্স