ডিএনএ-র ডাক্তারি, নোবেল ৩ বিজ্ঞানীর

লড়াইটা চলছে প্রতিনিয়ত। যদিও চোখের আড়ালেই। কখনও প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ছে সে, তো কখনও ‘গৃহযুদ্ধ’-এ। আক্রান্ত হচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ সব যুদ্ধেই সে জয়ী। নিজের জায়গায় অবিচল।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

স্টকহলম শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৫৫
Share:

টমাস লিনডাল, পল মডরিক ও আজিজ স্যানকার

লড়াইটা চলছে প্রতিনিয়ত। যদিও চোখের আড়ালেই। কখনও প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ছে সে, তো কখনও ‘গৃহযুদ্ধ’-এ। আক্রান্ত হচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ সব যুদ্ধেই সে জয়ী। নিজের জায়গায় অবিচল।

Advertisement

মানুষের দেহের প্রতিটি কোষে প্রতিনিয়ত ডিএনএ-র এই যুদ্ধ-জয়ের কাহিনি প্রকাশ্যে এনেই এ বারে রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী, টমাস লিনডাল, পল মডরিক এবং আজিজ স্যানকার।

কী সেই যুদ্ধ?

Advertisement

শুক্রাণুর ২৩টি ক্রোমোজোমের সঙ্গে ডিম্বাণুর ২৩টি ক্রোমোজোমের মিলন ঘটে তৈরি হয়েছি আমরা। সৃষ্টি হয়েছে আমাদের জিনোম। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটার পর নিষিক্ত ডিম্বাণু ভেঙে যায়। তার ডিএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি হয়ে যায়। ডিম্বাণু ভেঙে জন্ম নেওয়া প্রতিটি কোষে তৈরি হয় নতুন ক্রোমোজোম সেট। কোষ বিভাজন চলতেই থাকে। একটা থেকে দু’টো। দু’টো থেকে চারটে...।

এর সঙ্গেই একটি কোষ থেকে অন্য কোষে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে, বয়ে চলেছে জিন, বংশগতির একক। যা ঠিক করে মানুষকে কেমন দেখতে হবে, তার শারীরিক গঠন কেমন হবে কিংবা পারিবারিক কোনও অসুখ থাকবে কি না। এখন জিনের এই যাত্রাপথে মাঝেমধ্যে ভুলভ্রান্তি ঘটে যায়। বিপদে পড়ে ডিএনএ।

সমস্যায় পড়তে হয় ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও’। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন অতিবেগুনি রশ্মিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষের দেহকোষে উপস্থিত ডিএনএ। কখনও আবার কারসিনোজেনিক মেটেরিয়ালের (ক্যানসার-প্রবণ) সংস্পর্শে আসছে সে। এ ছাড়াও রোজ রোজ হাজার হাজার স্বতঃস্ফূর্ত বদলও ঘটে যাচ্ছে কোষের জেনেটিক মেটেরিয়ালে। ভুল হয়ে যাচ্ছে কোষের ছাপাখানাতেও। কোষ বিভাজনের সময় তার প্রতিলিপি তৈরি হতে গিয়েও অসংখ্য বার আক্রান্ত হচ্ছে ডিএনএ। কিন্তু একের পর এক হামলার পরও ডিএনএ-র গঠন কখনও ভেঙে পড়ছে না। নিজের কাজে সে অবিচল।

কী ভাবে? তার ব্যাখ্যাই দিয়েছেন জয়ী বিজ্ঞানীরা। একটি আণুবীক্ষণিক ব্যবস্থা অলক্ষ্যেই ডাক্তারি করে চলেছে সবসময়। নজরে রাখছে জিনের গঠনে। তার সমস্ত জখম সারিয়ে তাকে চাঙ্গা করে তুলছে।

’৭০-এর দশকের গোড়ায় মনে করা হতো, ডিএনএ খুবই পোক্ত, একট অদলবদল হওয়ার জো নেই। লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী লিনডালই প্রথম দাবি করেন, এমনটা মোটেই নয়। মানুষ ভাবতেও পারবে না, এমন গতিতে প্রতিনিয়ত জখম হচ্ছে ডিএনএ। কে তার জখম সারিয়ে তুলছে, কে তার সব ভুলভ্রান্তি ঠিক করে দিচ্ছে, সেটাই খতিয়ে দেখতে গবেষণার পরবর্তী ধাপ শুরু করেন লিনডাল। দেখা যায়, একটি আণুবীক্ষণিক ব্যবস্থা, প্রোটিন কণার একটি স্রোত প্রতি মুহূর্তে দেখাশোনা করছে ডিএনএ-র।

নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আজিজ স্যানকারের কাজটা ছিল কোষের ওই ‘ডাক্তারদের’ অর্থাৎ আণুবীক্ষণিক ব্যবস্থাপনাটির বিশদ মানচিত্র তৈরি করা।

হাওয়ার্ড হিউ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষক পল মডরিকের কাজটা ছিল একটু অন্য রকম। ডিএনএ প্রতিনিয়ত তার প্রতিলিপি ছেপে চলেছে। জীবনের এই ছাপাখানায় মাঝেমধ্যেই নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি ঘটে যায়। কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-র প্রতিলিপি গঠন হতে গিয়ে হয়ে যায় ‘মিসম্যাচ’। সেই ‘মিসম্যাচ’ কী ভাবে সারাই করে কোষ, তার খোঁজ দিয়েছেন মডরিক। দেখা যায় প্রোটিন কণার স্রোতটি অনবরত ডিএনএ-র ‘প্রুফ’ দেখে যাচ্ছে। ‘ছাপা’য় সামান্য ভুলচুক হলেই ঠিক করে দিচ্ছে সে।

রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর কথায়, ‘‘জীবিত কোষগুলো ঠিক কী ভাবে কাজ করে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন বুড়িয়ে যায় দেহ কিংবা পারিবারিক রোগগুলো কেন বংশপরম্পরায় তাড়া করে বেড়ায়, তারই ব্যাখ্যা দিয়েছে ওঁদের সুসংগঠিত কাজ। ব্যাপক ভাবে সাহায্য করছে ক্যানসার চিকিৎসাতেও।’’

বিজয়ীরা কী বলছেন?

সুইডিশ বিজ্ঞানী টমাস লিনডালের কথায়, ‘‘ডিএনএ-সারাই নিয়ে আরও অনেকে খুব ভাল কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে আমাকে বেছে নেওয়ায় ভাল লাগছে।’’

তুরস্ক থেকে আজিজই প্রথম বিজ্ঞানী নোবেল পেলেন। পুরস্কার যখন ঘোষণা হয়েছে, আজিজ তখন ঘুমোচ্ছিলেন। ফোন ধরেন তাঁর স্ত্রী। পরে তিনি জানালেন, স্ত্রী-ই তাঁকে ঘুম থেকে টেনে তুলে নোবেল জয়ের খবর জানান। ‘‘আশা করিনি। খুব চমকে গিয়েছি...। সকালটা খুব সুন্দর করে হল।’’ — বললেন আজিজ।

মডরিক নিউ হ্যাম্পশায়ারে ছুটি কাটাতে গিয়েছেন। কালই ছুটি শেষ। মনটা খারাপ ছিলই। এমন সময়ে আসে সুখবরটা। কী ভাবে উপভোগ করবেন নোবেল-জয়? বললেন, ‘‘বস্টন যাব। চার্লস রিচার্ডসনের সঙ্গে দেখা করব... বহু বছর আগে যাঁর কাছে পিএইচডি করেছিলাম, জীবনে ওঁর মতো মানুষকে পাওয়াটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন