পর পর দুটি গন্ডারের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে নিজেদের গাফিলতি ঢাকতে বন অফিসার-কর্মীদের একাংশ ট্রেজারি বিধিকে সামনে রাখছেন বলে বন মহলেই অভিযোগ উঠেছে। খোদ বনমন্ত্রী বিনয় বর্মনের সন্দেহও তেমনই। রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল নবীনচন্দ্র বহুগুণাও মানছেন, বন বিভাগের একেবারে শীর্ষ স্তর থেকে নিচুতলার মধ্যে কোথাও নজরদারিতে গলদ থাকাতেই গন্ডারের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
প্রধান মুখ্য বনপাল বলেন, “ট্রেজারি বিধি কিংবা কোনও অজুহাত দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। কোথাও একটা গলদ তো রয়েইছে। আমাদের কোন পর্যায়ে সেই ভুল হচ্ছে সেটা চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনে আমার স্তরেও খোঁজ নিতে হবে।’’ বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন জানান, গন্ডার কিংবা বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হলেই ট্রেজারি বিধির গল্প সামনে আনার আড়ালে কোনও ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা থাকতে পারে। বনমন্ত্রী বলেন, “ট্রেজারি বিধি চালুর পরে রাজ্যের অন্যত্র তো পাহারায়, নজরদারিতে অসুবিধে হচ্ছে না। তা হলে ডুয়ার্সে পর পর গন্ডারের মৃত্যু হলে ট্রেজারি বিধির কথা ওঠে কেন? এটা মানা যায় না। আমি রিপোর্ট পেলে পদক্ষেপ করব।”
যে কোদালবস্তিতে প্রথম গন্ডারের দেহটি মিলেছে সেখানকার পাহারার পরিস্থিতি একনজরে দেখে নেওয়া যাক। ওই বিটে এক জন বিট অফিসার, ২ জন বনকর্মী, ৫ জন চুক্তিতে নিযুক্ত বন শ্রমিক ও ২ জন বনশ্রমিক রয়েছেন। গত সোমবার ১১ অগস্ট সকাল দশটা নাগাদ ওই বিটের বড়োডাবড়ি-৬ কম্পার্টমেন্টের জঙ্গলে বানিয়া নদীর কাছে পচা গন্ধ পেয়ে বনকর্মীরা গন্ডারের মৃতদেহ দেখতে পান। গন্ডারটির খড়গ ছিল না। ওই ঘটনার পরে শুক্রবার জলদাপাড়া উত্তর রেঞ্জে পাওয়া যায় আরও একটি গন্ডারের মৃতদেহ। সেখানেও গন্ডারের খড়গ উধাও ছিল।
বনপাল বন্য প্রাণ (উত্তর মন্ডল) তাপস দাস বলেন, “নজরদারির ফাঁকের জন্য দু’টি গন্ডারের মৃতু্য হয়েছে। জলদাপাড়া উত্তর রেঞ্জের গন্ডারটির খড়গ ধারাল অস্ত্র দিয়ে কেটে নেওয়া হয়েছে। তবে কোদালবস্তি বিটের গন্ডারটির খড়গ কাটার চিহ্ন নেই। বাস্তব ঘটনা খড়গটি উধাও। নজরদারিতে ফাঁক না থাকলে কীভাবে গন্ডারের মৃতুর খবর এত দেরিতে মিলবে?”
প্রতিটি বিট ৯০০ থেকে ১৩০০ হেক্টরের মধ্যে থাকে। জানা গিয়েছে, কোদালবস্তি বিটের উত্তর পূর্ব দিকে যেখানে গন্ডারের দেহ পাওয়া গিয়েছে তার কাছেই হাসিমারা চিলাপাতা রাজ্য সড়ক রয়েছে। বনকর্মীদের দাবি ওই এলাকায় বর্ষা কালে এত ঝোপঝাড় হয়ে যায়, সেখানে পায়ে হেঁটে নজরদারি সম্ভব নয়। এলাকায় গন্ডার থাকায় কুনকি হাতি দিয়েই এলাকায় টহল চলত। জুলাই মাসের প্রথম দিকে ওই বিটের একমাত্র কুনকি হাতি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলে। তাতেই ওই এলাকায় নজরদারিতে ফাঁক তৈরি হয়। পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “বনকর্মীদের নজরদারিতে ফাঁক রয়েছে। তা ছাড়ার বনকর্তারও আগের মতো বনবস্তিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। ফলে চোরাশিকারিরা সেই সুযোগেই জঙ্গলে ঢুক গন্ডার মেরে খড়গ নিয়ে যাচ্ছে। জলদাপাড়ায় গন্ডার সংখ্যা একসময় ১৪য় নেমে আসে। শুধুমাত্র বনকর্মীদের নজরদারি নয়, বনবাসীদের সহযোগিতায় গন্ডারের সংখ্যা ২০০-র কাছাকাছি এসেছে। আবার গন্ডার মারা শুরু হয়েছে।” আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের চেয়ারম্যান অমল দত্তের সন্দেহ, বাইরের শিকারিরা স্থানীয়দের সহায়তা নিয়ে শিকার করছে। তাঁর মতে, “গন্ডারকে গুলি করলে অন্তত চার পাঁচ ঘণ্টা পরে মারা যায়। জঙ্গলে কোন এলাকায় বনকর্মীরা কখন টহলে যান, তা জানেন এক মাত্র বনকর্মী ও এলাকার বাসিন্দারা। তা ছাড়া রেঞ্জ অফিসার বিট অফিসারেরা বনকর্মীরা কাজ করছেন কি না, তা নিয়মিত তদারকি করেন না।”