হাতি আতঙ্কে ঘুম উড়েছে ঝাড়গ্রামের

সক্কাল বেলায় রেঞ্জ অফিসের বারান্দায় দিব্যি ঘুম দিচ্ছিলেন ভৈরব মল্লিক, অনন্ত শবর, জিতেন বেসরা-রা। সাত সকালে জঙ্গল ঘেরা গাঁয়ের লোকজন এভাবে সরকারি অফিসের বারান্দায় ঘুমিয়ে কেন?

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ০১:৪৪
Share:

অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্ষ।

সক্কাল বেলায় রেঞ্জ অফিসের বারান্দায় দিব্যি ঘুম দিচ্ছিলেন ভৈরব মল্লিক, অনন্ত শবর, জিতেন বেসরা-রা। সাত সকালে জঙ্গল ঘেরা গাঁয়ের লোকজন এভাবে সরকারি অফিসের বারান্দায় ঘুমিয়ে কেন? রেঞ্জ অফিসারের ডাকাডাকিতে বড় হাই তুলে অপ্রস্তুত ভৈরব বলেন, ‘স্যার, সারা রাত ঘুম হয়নি, তাই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’

Advertisement

সরকারি অফিসের বারান্দাটা কী ঘুমের জায়গা?

বনকর্মীদের কড়া-প্রশ্নের জবাবে মানিকপাড়ার ভৈরববাবুর মতো অনেকেই বলছেন, ‘বছর চারেক আগে মাওবাদীদের আতঙ্কে রাতে ঘুমোতে পারতাম না। মনে হত, এই বুঝি ওরা গ্রামে ঢুকছে! আর এখন হাতির আতঙ্কে রাত জেগে কাটাতে হচ্ছে। সকালে আবার দিনমজুরির কাজ না করলে দিনান্তে হেঁসেলে হাঁড়ি চড়বে না। তাই অভিযোগ জানাতে এসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি আর কী!’ কেউ কেউ অবশ্য বনকর্মীদের কড়া কথাও শুনিয়ে দিচ্ছেন। হাতিকে এলাকা ছাড়া না-করলে সপরিবারে সরকারি অফিসে গেরস্থালি পাতার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন তাঁরা। বনকর্মীদের একাংশ মানছেন, ক্ষোভের সঙ্গত কারণ রয়েছে। রেসিডেন্ট হাতির উত্‌পাতে ঝাড়গ্রাম ব্লকের ৩০-৪০টি গ্রামের বাসিন্দাদের রাতের ঘুম যে
উড়ে গিয়েছে!

Advertisement

গ্রামবাসীদের দাবি, চালাক হাতিরা এখন হামলার ধরনও বদলে ফেলেছে। আগে সন্ধ্যেবেলা বা রাতে হাতিরা গ্রামে ঢুকত। কিন্তু গত এক মাসে হাতির হামলার সময় বদলে গিয়েছে। বৃষ্টিভেজা রাতে বাসিন্দারা যখন কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন, ঠিক সেই মুহূর্তে রাত ১টা-দু’টো নাগাদ গৃহস্থের জানালায় উঁকিঝুঁকি মারছে দাঁতালরা। আবার কখনও ভোর হওয়ার ঠিক আগে লোকালয়ে হাজির হচ্ছে তারা। শুঁড়ে খাবারের ঘ্রাণ পেলেই দস্যি দাঁতালদের ‘অপরেশন স্টার্ট’। প্রথমে একটি হাতি গ্রামে ঢুকছে। বাসিন্দারা হাতি তাড়াতে শুরু করলে গুটি গুটি পায়ে আর একটি দাঁতাল অতর্কিতে ঢুকে বাড়ি-ঘর ভেঙে গৃহস্থের ঘরে মজুত ধান-চাল লুঠ করছে।

বন দফতরের হেল্প লাইনে ফোন করলে বনকর্মীরা যখন এসে পৌঁছচ্ছেন, তার আগেই কেল্লা ফতে করে পিঠটান দিচ্ছে দাঁতাল-হানাদার। ফলে, গ্রামবাসীরা নিজেরাই হুলা (মশাল) বানিয়ে তৈরি থাকছেন। গ্রামে হাতি ঢুকলেই বাসিন্দারা হা রে রে রে করে নেমে পড়ছেন খেদাও অভিযানে। গড়শালবনির বাসিন্দা পানু মাহাতো বলেন, “আমরা সবাই হাতি-তাড়ুয়া হয়ে গিয়েছি। রাতের ঘুম গিয়েছে।” মানিকপাড়ার ঝুনু লোধার বক্তব্য, “স্থানীয় হাতিগুলো পুরো বেপরোয়া ডাকাত হয়ে গিয়েছে। ওদের ভয়ে সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়ে দিচ্ছি।”

অভিজ্ঞ বনকর্মীরা বলছেন, দলমার দলছুট যে সব হাতি বছরের পর বছর দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলে স্থায়ী ভাবে ঘুরে বেড়ায় সেগুলিই রেসিডেন্ট। অন্যান্য বছরও রেসিডেন্ট হাতিরা বিভিন্ন মরশুমে এলাকায় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু এবার একটানা তিন মাস ধরে ঝাড়গ্রাম ব্লকে এভাবে হাতিদের ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকাটা বেশ অন্যরকম ঠেকছে। তাঁদের ধারণা, এলাকার গ্রামগুলিতে কার্যত রেকি করে হাতিরা বুঝে গিয়েছে, কোথায় কীভাবে সহজে খাবার পাওয়া সম্ভব। তাই গ্রামবাসীদের তাক লাগিয়ে হানা দিচ্ছে হাতিরা।

বন দফতর সূত্রের খবর, মাস তিনেক আগে ৭টি রেসিডেন্ট হাতি ঝাড়গ্রামে ব্লকের গড়শালবনির জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছিল। সেখান থেকে ওই হাতি গুলি এখন ছোট দলে ভাগ হয়ে ঝাড়গ্রাম, লোধাশুলি ও মানিকপাড়ার বিভিন্ন বনাঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতি দলে দু’টি হাতি থাকছে। বন দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক মাসে ঝাড়গ্রাম ব্লকের লোধাশুলি, ঝাড়গ্রাম ও মানিকপাড়া তিনটি ফরেস্ট রেঞ্জে হাতিরা ক্ষয়ক্ষতি চালিয়েছে। গত এক মাসে ঝাড়গ্রাম ব্লকে হাতির হামলায় ১৩২ টি মাটির বাড়ি ভেঙেছে। মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। এদিকে, মাঠে ধানের বীজতলা নষ্ট করে দিচ্ছে হাতিরা। চালের সন্ধানে প্রাথমিক স্কুল ও শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের দরজা ভাঙছে। প্রতিদিনই হাতির হানায় ভেঙে পড়ছে অজস্র মাটির বাড়ি।

ঝাড়গ্রামের ডিএফও ধর্মদেও রাই জানান, হাতিগুলিকে এলাকা থেকে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন