আমাদের দেশ থেকে কিছুতেই নিকেশ করা যাচ্ছে না তিন তালাকের মতো একপেশে আইন। ছবি: পিটিআই।
দ্বিতীয়টাও মেয়ে? গরিবের সংসারে আতঙ্কিত বাবা-মায়ের মাথায় ঘুরছিল সেই অবধারিত নামটিই— ইতি! মাটির চার-দেওয়ালের মাথায় খড়ের ছাউনি। তারই নীচে হিলহিলিয়ে বাড়ছিল দু-দুটো মেয়ে। পাথরখাদানে অল্প টাকার চাকরি। নুন জোগাড় হলেও পান্তা সব দিন জোটে না। তার ওপর বড়টার বিয়ে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব। এমন নিঃস্বতার গল্প তো আমাদের সবার জানা।
কিন্তু এটা গল্প নয়। বীরভূমের যে-গাঁয়ে আমার জন্ম, সেই তেঘরিয়ার ঘটনা।
অসহায় বাবা ফটিক ওরফে মহম্মদ হোসেনের গালে এখন দাড়ি, মাথায় টুপি। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়ে। প্রতি ওয়াক্তে আল্লাহর কাছে তার আর্জি কী, জানা যায় না। তবে, তবলিগি জামাতের দলে তাকে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। এ-হেন বাবার সেই মেয়ে ইতি এখন বাইশ পেরিয়েছে। সরকারি নাম-- নাসরিন আখতার। সব ঠিকঠাক চললে সামনের দশ মার্চ পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সে আকাশে উড়বে। বাইশ বছরের অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের পর ইতি বলতে পারবে, সে একটি বিখ্যাত বিমানসংস্থার এয়ার হোস্টেস! সেটা ঘটবে বিশ্ব নারী দিবসের ঠিক দু-দিন পর। আর, দু-দিন আগে, নারী দিবসের দিন সে পাবে চূড়ান্ত ছাড়পত্র। কীসের? আকাশে ওড়ার।
চেষ্টা করেও জানতে পারিনি, আর কত জন বাঙালি মুসলমান মেয়ে এই পেশা বেছে নিয়েছে। ইতির মুখে শোনা— এক জনই বিমানসেবিকা দিদিকে সে জানে, মুর্শিদাবাদের মেয়ে।
মুসলমান সমাজের, বাঙালি মুসলমান সমাজের, নানা রঙের এই ছবিটা— যা হয়তো কখনও-বা স্ববিরোধী— মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড কি চেনে, যারা আজও নানা অজুহাতে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা টিকিয়ে রাখতে চাইছে? বা, যে-জামাতের দলে ঘোরে ইতির বাবা, সেই জামাত কি জানে? ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবাংলায়, মুসলমান সমাজের মূল সমস্যা এইখানে।
কিন্তু, আচমকা তিন তালাক প্রথার কথা কেন তুললাম? দু’টো কারণে।
এক) সারা বিশ্বের মেয়েরা যখন লড়ছে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন সব জটিল বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে, তখন দুনিয়ার মুসলমান মেয়েদের পাক খেতে হচ্ছে দেড় হাজার বছর আগের এক নোংরা আবর্তে।
বিষয়টা একটু দেখি।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা কোরান অনুমোদন করে না। সুরা বাকারাহতে বলা হয়েছে, ‘যারা নিজেদের স্ত্রীর কাছে না যাওয়ার শপথ (কসম) করে, তারা চার মাস অপেক্ষা করবে, অতঃপর তারা যদি মিলে যায়, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (২২৬)
তার পরের বাক্যটিতে বলা হয়েছে, ‘আর যদি তারা তালাকই দিতে (বিবাহবিচ্ছেদ করতে) সংকল্প করে তবে আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ যদি দেওয়া হয়, তাহলে সেটিই প্রথম তালাক। কোরান বলছে, প্রথম তালাকের পর স্ত্রীর তিন রজঃস্রাবকাল অপেক্ষা করতে হবে। যদি ওই তিন মাস পর তারা ফের একসঙ্গে থাকতে চায়, তাহলে ‘এই সময়ের মধ্যে তাদের স্বামীদের তাদের পুনরায় স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার অধিকার আছে, যদি তারা আপোসে মিলেমিশে থাকতে চায়।’ (২২৮ সংখ্যক আয়াতের অংশ)
তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা কোরান অনুমোদন করে না। অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
কিন্তু তালাকের সিদ্ধান্তে স্বামী যদি অনড় থাকে? তখন সে যে-তালাক দেবে, সেটি দ্বিতীয়। এ ক্ষেত্রেও অপেক্ষার সময় তিন মাস। বনিবনা হলে ভাল। না হলে তৃতীয় এবং চূড়ান্ত তালাক। তৃতীয় তালাক সম্বন্ধে একই সুরায় ২৩০ সংখ্যক আয়াতে কোরান বলছে, ‘অতঃপর উক্ত স্ত্রীকে যদি সে তালাক দেয় তবে যে পর্যন্ত না ঐ স্ত্রী অন্য স্বামীকে বিবাহ করছে তার পক্ষে সে বৈধ হবে না। অতঃপর ঐ দ্বিতীয় স্বামী যদি তাকে তালাক দেয় তবে তাদের পুনর্মিলনে কারও কোন দোষ নেই, যদি উভয়ে মনে করে যে আল্লাহর নির্দেশ বজায় রেখে চলতে পারবে।’
হজরত মহম্মদের জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। ৪০ বছর বয়সে, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর মুখ দিয়ে কোরান প্রথম উচ্চারিত হয় আর সেটি ছিল সুরা আলাকের কয়েকটি বাক্য বা আয়াত। পরের ২৩ বছর ধরে একের পর এক সুরা আসতে থাকে। মোটা দাগে বলা যায়, সুরা বাকারাহ এসেছে ৬১০ থেকে ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক সময়ে।
তাৎক্ষণিক তিন তালাক কোরান মানছে না ঠিকই। কিন্তু, তৃতীয় তালাকের পর যে-বিধান দেওয়া হয়েছে, আজ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে সেই বিধান মান্য করা তো দূরের কথা, পড়তেই কি অস্বস্তি হয় না? হয় যে, তার প্রমাণ পাশেরই বাংলাদেশ। সেই ১৯৬১ সালে, অর্থাৎ পাকিস্তানি আমলেই, কোরানবর্ণিত এই প্রথাটি সেখানে বিলুপ্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে তালাক দেওয়ার নিয়ম এখন এত শক্ত আর প্রশাসননির্ভর যে, সবগুলো ধাপ ঠিক ঠিক অতিক্রম করে বিচ্ছেদকর্মটি সম্পূর্ণ করা বেশ পরিশ্রমের কাজ!
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বহু মুসলিমপ্রধান দেশে তালাক-আইনের আধুনিকীকরণ হয়েছে। এমনকী ঘোষিত ভাবে ইসলামি কয়েকটি দেশেও। কিন্তু আমাদের দেশ থেকে কিছুতেই নিকেশ করা যাচ্ছে না ওই একপেশে আইন।
ভারতে শেষ আদমসুমারি হয় ২০১১-য়। সেই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে চমকপ্রদ একটি তথ্য। বিবাহবিচ্ছেদের হার যেখানে মুসলিমদের মধ্যে ০.৫৬ শতাংশ, হিন্দুদের মধ্যে সেই হারটিই ০.৭৬ শতাংশ! এ রকমটা হল কী করে? তবে কি তালাকের জটিল প্রথা এড়িয়ে মুসলমান পুরুষরা একাধিক বিয়ে করে ফেলছে? এর উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা নিয়ে কোনও সমীক্ষা সরকার বা ল বোর্ড করেনি, ভরসা করতে হচ্ছে একমাত্র সমীক্ষাটির উপর, যেটি করেছে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন (বিএমএমএ)। তারা বলছে, সেনসাস থেকে পাওয়া তথ্য ঠিক নয়। তালাকের হার তার চেয়ে অন্তত ১১ ভাগ বেশি। সেইসঙ্গে তারা স্বীকারও করেছে, সীমিত ক্ষমতায় বিএমএমএ দু-দফায় সমীক্ষাটি করেছে। প্রথম দফায় মুখোমুখি হতে পেরেছে ১০টি রাজ্যের ৪৭১০ জন মহিলার। দ্বিতীয় দফায় ৮টি রাজ্যের ১১৭ জন মহিলার।
দুই) যে-মেয়েটি আকাশে ওড়ার জন্যে এই ক’টা দিন নিউ টাউনের একটা ছোট্ট ঘরে নিজের ডানা দুটো শক্ত আর সাফসুতরো করছে, পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে নীল আকাশ থেকে খুঁটে খুঁটে যে নিয়ে আসতে চাইছে নিজের আর বাবা-মায়ের পেটের ভাত, তার কাছে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথাটির কি কানাকড়িও দাম আছে?
সত্যিই নেই। কিন্তু সবাই তো আর ইতি ওরফে নাসরিন আখতার নয়! তারা কী করবে?