#মিটু: নারীত্বের অপমান তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ

এ বছরের শুরুতে টমসন রিউটেরস ফাউন্ডেশন ভারতকে মহিলাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। প্যান্ডোরার বাক্সের ঢাকনা খুলে যায়। লিখলেন মিমি সরকার২০১৮ এর ২৭ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত ১০ বছর আগে ঘটানো যৌন নির্যাতনের কঠোর অভিযোগ আনেন বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ ভারতে #মিটু আন্দোলনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

Advertisement

মিমি সরকার

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৮ ০৬:৪৮
Share:

অনেকেই মিটু আন্দোলনকে ২০১২ সালের দিল্লি গণধর্ষণ কাণ্ডের ছায়া হিসেবে দেখছেন। যে আন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার ধর্ষণের সাজার ধারা পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সমাজকর্মী জেসমিন পাথেজার মতে, #মিটু আন্দোলন এত জোরদার আকার ধারণ করবে যে, কোনও ভাবেই কোনও ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না বা ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজ্ঞ কামিনী জয়সোয়াল এ ক্ষেত্রে মহিলাদের শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষত, গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া এলাকায় যেখানে অধিকাংশ মহিলাই সামান্যতম বিদ্যালয় শিক্ষাটুকুও পাননি এবং আর্থিক ও আবেগ অনুভূতির দিক দিয়ে পুরুষের উপর সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভরশীল।

Advertisement

আবার, ভারতে প্রায়শই দেখা যায়, পারিবারিক প্রবল চাপকে অতিক্রম করেই মহিলাদের বাইরে বেরতে হয়। প্রথম থেকেই তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, তাঁর বাড়ি তাঁর একমাত্র কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে বাইরে বা কর্মক্ষেত্রে তিনি যদি বিব্রত অবস্থায় পড়েন, তখন পরিবার বা কর্মক্ষেত্র কোনও জায়গাতে তিনি ঠিক বিচারের আশা করতে পারেন না। ফলে, মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মহিলারা সাহসী হচ্ছেন এবং প্রতিবাদ করছেন যদিও কাজটা খুব সহজ নয় এখনও।

এই বছরের শুরুতে টমসন রিউটেরস ফাউন্ডেশন ভারতকে মহিলাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। তার অব্যবহিত পর থেকেই যেন প্যান্ডোরার বাক্সের ঢাকনা উন্মোচিত হয় এবং একে একে লিঙ্গবৈষম্যের বিভিন্ন ঘটনা সামনে আসতে শুরু করে। অগণিত মহিলা সাহসে ভর করে তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অবাঞ্ছিত ঘটনা সামনে নিয়ে আসতে থাকেন। #মিটু আন্দোলনের ফলস্বরূপ ব্লগার সিনা ডাভলকরের একটি টুইট পুনের বিখ্যাত পাব পুনে পাবকে বন্ধ করে দিতে সাহায্য করে। এবং মহেশ মূর্তি নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে পুলিশ কেস ফাইল হয়। ২০১৮ বর্ষবরণের রাতে বেঙ্গালুরুতে এই ধরনের একটি ঘটনার কথা সামনে এলে পুলিশ প্রথমে সম্পূর্ণ ভাবে তা অস্বীকার করে। কিন্তু #মিটু আন্দোলনের জেরে তা নিয়ে তদন্তে পুলিশ বাধ্য হয়।

Advertisement

২০১৮ এর ২৭ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত ১০ বছর আগে ঘটানো যৌন নির্যাতনের কঠোর অভিযোগ আনেন বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ ভারতে #মিটু আন্দোলনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তনুশ্রী দত্তের অভিযোগ এর পরেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কথা সামনে আনে। সংবাদমাধ্যম তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলি ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। সঞ্জনা সানহি উঠতি তারকা সুশান্ত রাজপুতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। পায়েল রোহতাগি দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে, মান্দানা কারিনী সাজিদ খান ও উমেশ গার্গেরর বিরুদ্ধে, তামিল অভিনেত্রী শ্রুতি হরিহরণ অর্জুন সারজার বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তুলে টুইট করেন। শুধু তাই নয়, ২১ অক্টোবর ২০১৮ সংগীত পরিচালক অনু মালিককে ইন্ডিয়ান আইডল সঙ্গীত প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলীর পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে অনেকগুলি যৌন হেনস্থার অভিযোগ সামনে আসায়।

রাজনীতির ক্ষেত্রে মারাত্মক অভিযোগ ওঠে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে। তাঁরই অফিসের কয়েক জন মহিলা কর্মী #মিটু আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। লেখিকা বিনতা নন্দা মারাত্মক অভিযোগ আনেন আরেক বর্ষীয়ান অভিনেতা অলোকনাথের বিরুদ্ধে। অলোকনাথের স্ত্রী আশু সিংহ নন্দার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। এই ঘটনা মনুষ্যত্ববোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে বিবাহ সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক নির্ভরতা টিকিয়ে রাখার একটি বিরাট প্রচেষ্টা নয় কি? যতদিন পর্যন্ত পরিবারের অভ্যন্তরে এই মানসিকতা বজায় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত সমাজের কোনও পরিবর্তন সাধিত হবে না। ২০১৪ সালের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, ৮৬ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পরিবারের অভ্যন্তরে খুব কাছের সম্পর্কগুলির দ্বারা অথবা প্রতিবেশী, সহকর্মী বা বন্ধুদের দ্বারা। সুতরাং, বলা যায়, #মিটু আন্দোলন শুরু হোক পরিবারের অভ্যন্তর থেকে।

অনেক ক্ষেত্রেই ১০ থেকে ১৫ বছর আগের ঘটনা সামনে আসছে। তবে একথাও মনে রাখা দরকার, যেসব অভিযোগ #মিটু আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সামনে আসছে, তার সবগুলিই প্রকৃত ঘটনার না-ও হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মহিলারাও হাই-প্রোফাইল পুরুষকে তাঁদের সাফল্যের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। ফলে, আন্দোলনকে যেন কেউ নিজের স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারেন, তার দিকে লক্ষ রাখা উচিত। #মিটু আন্দোলনের প্রসারতার দিকে লক্ষ রেখে সরকার ২০১৮-র ২৪ অক্টোবর একটি জিওএম কমিটি গঠন করেছেন। চারজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিয়ে #মিটু প্যানেল তৈরি হয়েছে, যার প্রধান হলেন রাজনাথ সিং। অন্যেরা হলেন মানেকা গাঁধী, নির্মলা সীতারামন এবং নিতিন গডকড়ি। এছাড়া সরকারি কর্মক্ষেত্রে ইলেক্ট্রনিক কমপ্লেইন বক্সও চালু হয়েছে।

শেষে বলা যায়, #মিটু আন্দোলন শুধুমাত্র কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বাসে, ট্রেনে, রাস্তাঘাটে, প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ও পিছনে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলে, আমরা জানি। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারি না। লিঙ্গবৈষম্য এবং যৌনহেনস্থাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা সর্বস্তরে বন্ধ হওয়া উচিত। ভারতীয় মহিলাদের সামনে #মিটু আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের নারীত্বের অপমানের কথা তুলে ধরার এক সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। সবাই মিলে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারলে আগামী প্রজন্মের জন্য ভাল বার্তা রাখা যাবে।

সীতানগর স্কুলের বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন