হকি স্টিক হাতে মরিয়া দৌড় দুর্গাদের

হকি স্টিক শক্ত করে ধরে বলের পিছনে দৌড়চ্ছিল মেয়েটা। ঠিক মতো বাড়াতে পারলেই গোল। 

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০২:০৩
Share:

হকি অনুশীলনে মেয়েরা। কৃষ্ণনগরে। —নিজস্ব চিত্র।

হকি স্টিক শক্ত করে ধরে বলের পিছনে দৌড়চ্ছিল মেয়েটা। ঠিক মতো বাড়াতে পারলেই গোল।

Advertisement

কিন্তু কোথায় কী? তার আগেই মেয়েটা ঘাসে ঢলে পড়ল। হবে না কেন? আগের দিন রাত ৮টায় ভাত খেয়েছিল। সকালে একেবারে খালি পেটে এসে নেমেছে মাঠে।

মামনি বিশ্বাস— এরই মধ্যে সে বাংলার হয়ে বারো বার ‘ন্যাশনাল’ খেলেছে। বাবা নেই। মা অসুস্থ। ভাই স্কুলে পড়ে। কাপড় রং করে সংসার চালিয়ে স্কুল সামলে রোজ সকালে সে আসে মাঠে। বেশির ভাগ দিন পেটে একটা দানাও পড়ে না।

Advertisement

মাঠে লুটিয়ে পড়া মেয়েটাকে তুলতে-তুলতে কোচ হিমাংশু ঘোষ বলেন, “একটু পুষ্টি দরকার এদের। তা-ও দিতে পারি না।” উল্টো দিক থেকে ছুটে এসেছিল মনীষা ভকত। প্রথম বর্ষের এই ছাত্রীটি ১৪ বার জাতীয় স্তরে খেলে ফেলেছে। গজগজ করে— “বললাম, দুটো ছোলা নে। নিলই না। এখন বোঝ!” মনীষার মা রাঁধুনির কাজ করেন, বাবা দিনমজুর। সংসারে অভাব সামলে মেয়ের জন্য মুঠোখানেক ছোলা জুগিয়ে দেন রোজ। তাতে আর ভাগ বসাতে চায় না মামনি।

২০১০ সালে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের মাঠে মেয়েদের হকি টিম বানিয়ে অনুশীলন শুরু করেছিলেন শহরের প্রাক্তন কয়েক জন হকি খেলোয়াড়। সেই শুরু। দিনে-দিনে ভিড় বেড়েছে। রোজ সকাল হলেই মামনি, মনীষা, সুপ্রিয়া, মুসকানেরা হাজির হয়ে যায় মাঠে। রোদের ঝাঁঝ বাড়া পর্যন্ত চলে অনুশীলন। স্বপ্ন দেখে হকি খেলে একটা ভাল জীবনে পৌঁছে যাওয়ার।

একটা ভাল হকি স্টিকের জন্য এখন টাকা জমাচ্ছে মনীষা। দাম পড়বে কমপক্ষে আড়াই হাজার টাকা। মনীষার জমেছে মোটে তিনশো। বাকিটা? পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘাস পিষে দিতে-দিতে মেয়েটা বলে, “জানি না। তবে কিনবই!” রঙ ওঠা জার্সিটা বদলে ফেলার কেনার স্বপ্ন দেখে মামনি, রানি সাউ, সুপ্রিয়া বাহাদুরেরাও। কারও বাবা লরির খালাসি, কারও বাবা দিনমজুর আর কারও রিকশাচালক।

বছর চোদ্দোর মুসকানের দিনমজুর বাবা চাননি, মেয়ে মাঠে নেমে ছেলেদের মতো খেলাধুলো করুক। তবে তাঁর আপত্তি ধোপে টেকেনি। ছত্তীসগঢ়ে ‘ন্যাশনাল’ খেলে এসেছে মেয়ে। এখন বাবাও বুঝেছেন, মেয়ে যদি কোনও ভাবে তাঁর মাথা উঁচু করতে পারে তো এই হকি খেলেই। একই লড়াই জিততে চাইছে সালমা খাতুনও। কলেজ মাঠের প্রথম বারের ব্যাচের অন্যতম সদস্য অপরাজিতা পাল এখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ন’বার জাতীয় স্তরে খেলা হয়ে গিয়েছে তার। অপরাজিতা বলে, “অনেকটাই স্যররা জোগাড় করে দেন। ঠিক মতো পুষ্টিই মেলে না তো নিজস্ব উপকরণ।”

হিমাংশু বলছেন, “অদম্য ইচ্ছা আর জীবনীশক্তিই ওদের সম্বল। তা দিয়েই দারিদ্র্যের অসুরের সঙ্গে ওদের অসম লড়াই।”

হকি স্টিক আয়ুধ করে এখন মাঠ জুড়ে দৌড়চ্ছে এক ঝাঁক দুর্গা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন