নতুন চেহারায় বার্বি পুতুলেরা। ছবি: বার্বির টুইটার অ্যাকাউন্টের সৌজন্যে
পুতুলই ছিল সে, কিন্তু পুতুল পুতুল গড়ন বলতে যা বোঝায় সেটা ছিল না। বরং তাকে দেখতে ছিল সাইজ জিরো সুপারমডেলের মতো।
ফল? সেই ফ্রক পরা বয়স থেকেই বার্বির মতো তন্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখত খুদে কন্যেরা। আর গুরুজনেরা বলতেন, কী কাণ্ড! সাধারণ ঘরের মেয়েদের এমনতর চেহারা হয় নাকি আবার?
এত দিনে বুঝি অপ্সরা মর্ত্যে এলেন! সম্প্রতি টুইটারে প্রকাশ পেল, নতুন স্বাস্থ্যবতী বার্বির ছবি। দুনিয়া জুড়ে এক ডাকে চেনা জনপ্রিয় ব্র্যান্ডটি এ বার মোটাসোটা, কার্ভি চেহারায়। সৌন্দর্যের সংজ্ঞাকে আরও ব্যাপ্তি দিতেই এই পদক্ষেপ, দাবি করছে বার্বির নির্মাতা সংস্থা ম্যাটেল।
৫৭ বছর আগে বার্বির রূপদান করেন ম্যাটেল সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাত্রী রুথ হ্যান্ডলার। তারপর নয় নয় করে এই তিলোত্তমা পেয়েছে ১৫০টিরও বেশি দেশের নাগরিকত্ব, ৯০টিরও বেশি পেশায় যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা। সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে দশ জনের লোকের
মধ্যে ন’জন বার্বির নাম জানেন। তা হলে এই ষাটের কোঠায় এসে ভরভরন্ত শরীর গড়ার ধুম পড়ল কেন? রোগা হতে হতে কি হাঁপিয়ে পড়ল বার্বি? নাকি বয়সের ভারে আর ডায়েটিং-এ নজর নেই?
ম্যাটেলের দাবি, আজ্ঞে না। এ হল বার্বির নতুন যুগের নতুন যৌবন। নতুন এই শরীরী নকশা অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও বাস্তবসম্মত। সারা পৃথিবীর যে অসংখ্য শিশুকন্যা বার্বি পুতুল নিয়ে তাদের খেলাঘর সাজায়, তাদের শারীরিক গঠন তো এক রকম নয়। নতুন বার্বি সেই বৈচিত্রকেই তুলে ধরবে। বার্বির গ্লোবাল জেনারেল ম্যানেজার ইভলিন ম্যাজেকো জানিয়েছেন, ‘‘সারা বিশ্বের বালিকারা তাদের আশপাশে যেমন চেহারা দেখে, বার্বিকেও আমরা তেমন করার চেষ্টা করেছি, যাতে তাদের প্রিয় পুতুল তাদের মনের আরও কাছাকাছি আসতে পারে। বার্বির আরও সাত রকম গায়ের রং, ২৪ রকম নতুন চুলের স্টাইলও যোগ করা হয়েছে।’’
বার্বির এই বাস্তবের কাছাকাছি আসাটাই ‘দুর্দান্ত’, মনে করছেন ফ্যাশন ডিজাইনার কিরণ উত্তম ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘বাস্তবের নারীদের যে সৌন্দর্য, বার্বি এ বার তারই মতো হতে চাইছে। এটা একটা অসাধারণ ভাবনা।’’ তাঁর মতে, ‘‘বার্বির এই ‘রিয়েলিটি চেক’টা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।’’
ইদানীং সৌন্দর্যের ধারণা বদলাতে শুরু করেছে পশ্চিমেও। আজকের বিউটি-আইকন শাকিরা, রিহানা, জেনিফার লরেন্স, আনা কুরনিকোভারা কেউ রোগা প্যাঁকাটি নন। বলিউডেও ‘জিরো-ফিগার’ এখন আর ততটা ফ্যাশনেবল নয়। ‘টশন’ ছবিতে করিনা কপূরের ‘জিরো-ফিগার’ বক্স-অফিসকেও উপোসী রেখেছিল। আজকাল বরং নিজেদের কার্ভি চেহারা নিয়েই ঝড় তুলছেন বিদ্যা বালন, সোনাক্ষী সিংহরা। অগ্নিমিত্রা পালও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘ভারতীয় ঐতিহ্যে কখনওই সুন্দর নারীর চেহারা বার্বির মতো অমন রোগা ছিল না। খাজুরাহো, অজিণঠা-ইলোরা, কোনারকের মন্দির দেখলেই তা বোঝা যায়।’’
সাইজ-জিরোর মোহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার স্বাস্থ্যগত কারণও রয়েছে, জানাচ্ছেন পুষ্টি বিশারদেরা। জন্মলগ্ন থেকেই স্কুলপড়ুয়া খুদেদের মনে নারীশরীরের এক অবাস্তব ও অস্বাস্থ্যকর ধারণা তৈরির করার সমালোচনা বার্বির পিছু ছাড়েনি। ১৯৬৩ সালেই বার্বি হাজির হয়েছিল হাতে একটা বই নিয়ে, যার বিষয় ছিল ওজন কমানোর উপায়। তার বিরুদ্ধে রীতিমতো সরব হন চিকিৎসকেরা। কারণ, বার্বির মতো চেহারা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়েছিল বহু ছাত্রী। ২০১৫-র জুলাইয়ের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী এখনও ইউরোপে ১৪ বছরের বালিকাদের ৪০ শতাংশ ডায়েটিং করে, যা মোটেই সর্বাংশে কাম্য নয়।
আমাদের দেশেও সমস্যাটা সত্য, বলছেন পুষ্টি বিশারদ সুদেষ্ণা মৈত্র। তিনি বলেন, ‘‘বার্বির জিরো ফিগারের যে বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স), তা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। প্রয়োজনীয় মেদ না থাকলে আয়ু কমে যেতে পারে। নতুন যুগের বার্বি যে স্বাস্থ্যকর শরীরের দিকে ঝুঁকেছে, সেটা ভাল সিদ্ধান্ত।’’
বার্বির এই কায়া-বদলের একটা অর্থনৈতিক দায়ও অবশ্য রয়েছে বলে অনেকের মত। গত অক্টোবরেই বার্বি তার বিশ্বব্যাপী বিক্রি ১৪% কমেছে বলে কবুল করেছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবী বিদ্যাচর্চার অধ্যাপক শমিতা সেনের কথায়, ‘‘হলিউড তার ছকে-বাঁধা সৌন্দর্যের ধারণা থেকে অনেকটা সরে এসেছে। বিশ্বায়নের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান বাজারের কাছে পৌঁছনোও তো দরকার। তাই চেহারা বদলে সারা বিশ্বের ‘ঘরের মেয়ের’ হয়ে ওঠার দায় কম নয়।’’