সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বেনোর ব্রোঞ্জ মূর্তিতে ভক্তদের শ্রদ্ধা।
মহান মানুষেরা তাঁদের পায়ের ছাপ বালির উপর রেখে যান। রিচি বেনো তাঁর অননুকরণীয় কণ্ঠস্বর রেখে গেলেন কমেন্ট্রি বক্সে। এখন থেকে ধারাভাষ্যকারদের নিজেদের উচ্চারিত শব্দ, মনের ভাব, ব্যঞ্জনা, যতি— সব কিছুর প্রতি ন্যায়বিচার করার দায় ঘাড়ে চেপে বসল। নীরবতাকে বেনো ফ্যাশনে পরিণত করেছিলেন। কিছু না বলেই তিনি প্রায়শই সব বলে দিতেন।
উনিশশো ছিয়ানব্বইয়ে ইংল্যান্ডে বিবিসির হয়ে আমার ধারাভাষ্যকার জীবনের একেবারে প্রথম দিনই এই গ্রেট আমাকে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। বেনো, লুইস, বয়কট এবং গাওয়ারের মধ্যে আমাকেও পা রাখার ভরসা করা হয়েছিল। আমাকে ওঁর প্রথম কথাগুলো ছিল একেবারে সঠিক সময়ে: ‘রবি’, বলে উনি শুরু করেছিলেন, ‘‘মনে রেখো, তোমাকে টাকা দেওয়া হচ্ছে কতগুলো কথা বললে তার জন্য নয়, বরং তোমার কথার সারবত্তার জন্য।’’ আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই যে, বিশ্বের এই অংশে এই বক্তব্যটা কার্যকর কি না? কথার উদরাময় হওয়াটাই যেন এখানে নিয়ম! তার মানে এই নয় যে, মহান মানুষটির পরামর্শ আমি অনুসরণ করি না। ওঁর পরামর্শ এখনও পুরোপুরি মেনে চলি। ওটাই আমার মন্ত্র হয়ে থাকবে বরাবর।
ক্রিকেটার হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম, উনি স্পিনারদের ভালবাসেন। ১৯৮৫-তে আমি তখন বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের সাফল্য থেকে সবে উঠেছি। লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণনও। ওই মরসুমে আমরা ইংল্যান্ডে লিগ ক্রিকেট খেলছিলাম। ট্রেন্টব্রিজে অ্যাসেজ টেস্ট চলার সময় কমেন্ট্রি বক্সে বেনোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হল। পরের দৃশ্যেই আমরা ওঁর সামনে! শিবাকে দেখে মনে হচ্ছিল, বইয়ের দোকানে ঢোকা এক ছাত্রের মতো। যার কান দুটো বাধ্য কুকুরের মতো খাড়া! আর আমার তখন ওঁর প্রশংসায় মাথা ঝিমঝিম করছে: ‘‘এ বারের গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়ায় তোমাদের দু’জনকে দেখতে খুব ভাল লেগেছে।’’
বেনো কোনও দিন ভারতে মাইক ধরেননি। হয়তো আমাদের দেশের উইকেটে বল হাতে ওঁর কার্যকলাপের উপর বাড়তি পালিশ দরকার ছিল না। ওঁর বোলিং গড় আপনাকে হতভম্ব করে দেবে। কোনও স্পিনার বা পেসার ওঁর মতো যন্ত্রণাদায়ক কি না, আমার সন্দেহ আছে। এ রকম এক পরিসংখ্যানের দিকে তাকাবেন না: ব্যাপারটা গরম কয়লা হাতে নেওয়ার মতো হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমার অনেক দিনের পুরনো বন্ধু মার্ক মাসকারেনহাস এক বার ওর পরম আন্তরিকতায় বেনোকে শারজায় ফ্লাইটে ওঠাতে পেরেছিল। কমেন্ট্রি করানোর জন্য। উপমহাদেশে ওখানেই বেনো একমাত্র কমেন্ট্রি করেছেন। মরুভূমির ভয়ঙ্কর ধুলোও ওঁর ঘি রঙের স্যুট আর কমবয়সি পল ম্যাককার্টনির মতো হেয়ারস্টাইলের বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। বেনো, গ্রেগ, সোবার্স এবং ইয়ান চ্যাপেলের সঙ্গে এক সন্ধের আড্ডা আমার মিডিয়া কেরিয়ারে সেরা অভিজ্ঞতা।
এটাই তাঁর ম্যাজিক। বহু বছর পরেও আপনার ওঁর ধারাভাষ্যের কথাগুলোই মনে পড়বে, যে বিষয়টা নিয়ে উনি ধারাভাষ্য দিয়েছিলেন তার চেয়ে। ১৯৯৫-৯৬-এ সিডনি টেস্টের শেষ দিন ওয়ার্ন রাউন্ড দ্য লেগ বাসিত আলিকে বোল্ড করল। বেনো একটা লম্বা যতি দিয়ে বললেন, ‘‘কেউ বিশ্বাস করবে! ও ব্যাটসম্যানকে দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে বোল্ড করেছে!’’ একেবারে স্পট অন! ওঁর কথাগুলো লোকগাথা হয়ে ওঠার জন্য কিছু অ্যাকশনেরও দরকার ছিল।
বেনোও কি কিছু ভুলত্রুটি ঘটিয়েছেন? বাজি ধরতে পারেন, হ্যাঁ। কিন্তু উনি সেটাকে পাত্তাই দেননি। ‘যা হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে। কখনও ভুল শুধরোতে যেও না। তাতে হয়তো আরও ভুল করে বসবে,’’ বেনো এক বার শুষ্ক ভাবে বলেছিলেন।
মাঝেমাঝে মনে হয়, বেনো ইংরেজিটা বলতেন জার্মানের জার্মান বলার মতো— কর্কশ ভাবটা বাদে। ওঁর মুখের ভেতরে জমা শব্দগুচ্ছ রেশম আর কাঠের মিলিত গুড়গুড়ানি তৈরি করত।
ক্রিকেট সমাজ তার শ্রেষ্ঠ দূতদের এক জনকে হারাল। চিরতরে।
ছবি: এএফপি এবং ফাইল চিত্র।