জয়-পরাজয়ের ভাবনা ভুলে রূপান্তরের কাহিনি

বেলজিয়ামকে ‘ডেভিলস’ করে তুলেছে এক প্রফেসরের পাগলামি

ছত্রিশ বছর পর ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আবার চোখ ঝলসে দিচ্ছে বেলজিয়াম... আবার তারা দেশের ফুটবল ইতিহাসের পাতায় এক স্বর্ণগাথা লেখার অপেক্ষায়...

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

প্যারিস শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০৩:২৯
Share:

গুরু স্যাবলনের (উপরে ইনসেটে) শিষ্য হ্যাজার্ড

ছত্রিশ বছর পর ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আবার চোখ ঝলসে দিচ্ছে বেলজিয়াম... আবার তারা দেশের ফুটবল ইতিহাসের পাতায় এক স্বর্ণগাথা লেখার অপেক্ষায়... বেলজিয়াম ফুটবলের সোনার সময় ফিরে এসেছে আবার, এসেছে এক ঝাঁক অসম্ভব প্রতিভাবানের হাত ধরে... ছত্রিশ বছর পর তারা আবার ইউরো ফাইনালের দিকে ছুটছে, চুরমার করে ছাড়ছে একের পর এক প্রতিপক্ষকে...

Advertisement

মাইকেল স্যাবলন ফরাসি ভাষা কতটা জানেন, বলতে পারেনও বা কতটা, কে জানে। তবে তাঁর এক কোটি দশ লক্ষের দেশে এথনিক জার্মান পাওয়া যায়, ডাচ বলিয়ে ইংরেজ আছে, ফরাসিও প্রচুর। আন্দাজ করা যায়, কিছুটা তিনি জানলেও জানতে পারেন। আর জানলে, বেলজিয়াম নিয়ে বিখ্যাত ফরাসি দৈনিকের লেখাটা তাঁর নিঃসন্দেহে ভাল লাগত। লাগাও উচিত। লেখাটা বড় বেশি সুন্দর, বড় বেশি মন ছুঁয়ে যাওয়া।

সত্যি, ছত্রিশ বছর!

Advertisement

প্যারিসে মালাকফ নামে যে জায়গাটায় আছি, তার খুব কাছে মেট্রো স্টেশন। সঁজেলিজে, আইফেল টাওয়ার বা ল্যুভরের মতো ট্যুরিস্টদের মৃগয়া কেন্দ্র বাদ দিলে প্যারিসের অধিকাংশ অঞ্চল বেশ শান্ত, চুপচাপ। নিজেদের প্রিয় দেশকে তারা যেমন সাজিয়ে রাখে, পথের ধারের রেলিংয়ে যেমন আচমকা চোখে পড়ে বেঁধে রাখা অনিন্দ্যসুন্দর ফুলের তোড়া, ফরাসিরা তেমন সৌন্দর্যকে সম্মানও করতে জানে। হইহল্লা, চিৎকার খুব একটা শোনা যায় না। রাত-বিরেতে তো আরওই না, মেট্রোর আসা-যাওয়ার শব্দ তখন আরও স্পষ্ট, আরও পরিষ্কার। পরশু রাতে মেট্রোর শব্দ শুনতে পাওয়া তাই ব্যতিক্রমী নয়, আশ্চর্য বরং তার মধ্যেকার গলার আওয়াজগুলো। এত রাতে ওরা কারা? মেট্রো করে ফিরছে?

কারা আর? নিশ্চয়ই বেলজিয়ান সমর্থক, হাঙ্গেরিকে চার গোল দিয়ে যারা ফিরছে।

মাইকেল স্যাবলনের নির্ঘাৎ এটাও ভাল লাগত। সৃষ্টিকর্তারও তো মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করতে পারে নিজের সৃষ্টির মধ্যে ডুব দিতে, হারিয়ে যেতে। আজ পর্যন্ত স্যাবলন যেখানে-যেখানে হাত রেখেছেন, সর্বত্র সাফল্যের মুকুট যে মাথায় উঠেছে এমন তো নয়। ইতালিয়া ’৯০-তে বেলজিয়াম টিমের কোচিং স্টাফের মধ্যে একজন ছিলেন স্যাবলন। রবিবারের মতোই শেষ ষোলোর ম্যাচ ছিল, যা পরিষ্কার দিকনির্দেশ করছিল পেনাল্টি শুটআউটের। স্যাবলন সে দিন একটা সাদা কাগজ বার করে পেনাল্টি-মারিয়েদের নাম লিখতে বসে গিয়েছিলেন। এবং লেখা-টেখা শেষে আবিষ্কার করেছিলেন, ডেভিড প্লাট তাঁর কাগজ-কলমকে নিষ্প্রয়োজন করে দিয়েছেন। এতটাই হতাশ হয়ে পড়েন স্যাবলন যে, কাগজটাকে ছুড়ে ফেলে দেন।

প্রায় এক দশক পর সাদা কাগজ বার করতে হয়েছিল।

কাহিনিতে ঢোকার আগে মুখবন্ধের কাজ সেরে নেওয়া ভাল। মাইকেল স্যাবলন কে, কী ভূমিকা, কেন এডেন হ্যাজার্ড-দে ব্রায়েনদের রূপকথা-প্রসঙ্গে তিনি বারবার, একটু বলে নেওয়া ভাল। আসলে মাঠে আমরা মার্ক উইলমটসের টিমকে দেখি, দেখি হ্যাজার্ডের মন ভাল করে দেওয়া স্প্রিন্ট, অবিশ্বাস্য সেভে কোনও এক থিবাও কুর্তোয়ার দেশের জার্সি গায়ে ম্যানুয়েল ন্যয়ার হয়ে উঠতে চাওয়া। কিন্তু কোথাও প্রফেসর-প্রফেসর দেখতে ওই সাদা চুলের ভদ্রলোককে দেখতে পাই না। অথচ রেড ডেভিলসের (ইউনাইটেড শুধু নয়, বেলজিয়াম টিমকেও বলে) প্রত্যেকটা ম্যাচে তিনি অদৃশ্য ভাবে মাঠে থাকেন, জার্সি পরে খেলতে নামেন। রূপান্তরের বেলজিয়ামের জনক তিনি, তিনি না থাকলে হ্যাজার্ডদের যে দেখাই যেত না!

ধন্য ‘প্রোফেসরের’ অধ্যাবসায়, ধন্য স্যাবলনের প্রতিজ্ঞা, মনের জোর। এনজো শিফো চলে যাওয়ার পর বেলজিয়াম ফুটবলের গর্ব বলতে একটা সময় কিছু ছিল না। আটানব্বই বিশ্বকাপে তারা গ্রুপ পর্ব থেকে উড়ে গিয়েছিল, দু’বছর পরের ইউরোতেও দাঁড়াতে পারেনি। দেশের ফুটবল-কাঠামো ভেঙে পড়ছিল। স্কুল পর্যায় থেকে ভাল প্লেয়ার তোলার উপযুক্ত ফুটবল-দর্শন ছিল না। আট বছরের শিশুকে বলা হত, তুমি লিবেরো খেলো! যে কিশোর সুইপার খেলে তাকে বলা হত তুমি বেকেনবাউয়ার-ঘরানায় চলে যাও! বেলজিয়ান ফুটবল দাঁড়িয়ে ছিল ধ্বংসস্তুপে, কেউ ফুটবলকে বান্ধবী ভাবতে পারত না।

ইতালিয়া ’৯০-এর এক দশক পর ফুটবল ফেডারেশনের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে ফিরে এসে স্যাবলন যা চুরমার করে দেন। প্রথমত, দেশে আয়োজিত ইউরো থেকে (২০০০, নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যৌথ ভাবে) প্রাপ্ত অর্থের সিংহভাগ ঢেলে দেন ফুটবল উন্নতিতে। তুবিজে নতুন জাতীয় ফুটবল সেন্টার তৈরি হয়। যেখানে ফুটবল-টিউটোরিয়াল নেওয়া যাবে বিনামূল্যে! ব্যস, এক ধাক্কায় আবেদনকারীর সংখ্যা দশগুণ বেড়ে যায়। স্যাবলন এর পর পাগলের মতো খাটতে শুরু করেন। ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের জাতীয় টিম কোন ফুটবল-দর্শনে চলে, তা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দেন। দেশে ফুটবল-সেমিনার ডাকেন, আদর্শ টিম ফর্মেশন, ট্রেনিং মেথড নিয়ে আলোচনা-চক্র বসিয়ে দেন। পরে একবার স্যাবলন বলেছিলেন যে, ওই সময় তাঁদের দিন-রাত বলে কিছু ছিল না। “আমরা সকালে কাজ শুরু করতাম, শেষ করতে করতে রাত হয়ে যেত। শনি-রবি বলে কিছু ছিল না। পাগলের মতো লাগত।”

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, পাগলামিটা ফুটবল-প্রফেসর দেখিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন বলে দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর পর দেশজ ফুটবলের সার্বিক পরিবর্তনের মাস্টারপ্ল্যানটা বেরিয়েছিল। দেখিয়েছিলেন বলে, ছত্রিশ বছর পর রূপকথার ট্রেনে উঠে পড়েছে বেলজিয়াম। দেখিয়েছিলেন বলেই হাঙ্গেরিকে হারিয়ে উঠে আজ এডেন হ্যাজার্ড বলতে পারছেন, “এটা আমার, আমাদের সেরা পারফরম্যান্স। আমরা গোল করেছি, প্রচুর সুযোগ তৈরি করেছি, আবার দুর্দান্ত সব গোলও বাঁচিয়েছি।” স্যাবলনের মাস্টারপ্ল্যান খুব সহজ ছিল— ফরাসি ফুটবলের শক্তি আর ট্যাকটিক্যাল দক্ষতা নাও। ডাচদের স্বপ্নের টেকনিক ধার করো। এবং নতুন ঘরানার আক্রমণাত্মক ফুটবল আবিষ্কার করো, যা উত্তেজক হবে।

নাম গ্লোবাল-অ্যানালিটিকাল-গ্লোবাল বা জি-এ-জি।

কাজও শুরু হয়ে যায়। তরুণদের বলা হতে থাকে, হার-জিত নিয়ে ভাবতে হবে না। মাঠে নেমে সৃষ্টি করো, ফুটবল খেলে নিজেকে আগে সুখ দাও। ড্রিবল শেখো, ডিফেন্সিভ ফর্মেশন ধ্বংস করে ৪-৩-৩ খেলো। দে ব্রায়েনের স্কিল, হ্যাজার্ডের ক্রস, লুকাকুর নিখুঁত গোল দেখলে যা মনে পড়বে, বোঝা যাবে কোন মায়ায় নতুন বেলজিয়াম খেলে পুরনো ডাচদের মতো।

বুকের পাটা ছিল স্যাবলনের। ২০০৬ বিশ্বকাপের সময় ফেডারেশন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে বেলজিয়াম কোথায় দাঁড়িয়ে? টিডি মুচকি হেসে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, “কোথাও না!” জয়-পরাজয়কেই শিফোর দেশ থেকে তুলে দিয়েছিলেন স্যাবলন। সমস্যা ছিল আরও, সবচেয়ে বড় ছিল নতুন পরিকাঠামোয় উঠে আসা প্রজন্মের খামখেয়ালিপনা সামলানো। হ্যাজার্ডকে একবার এক ম্যাচে তুলে নেওয়ার পর তিনি পার্কিং লটে বার্গার খেতে চলে গিয়েছিলেন। দেখেশুনে বেলজিয়ান মিডিয়া এই প্রজন্মের নামকরণ করেছিল, ‘ভিটন জেনারেশন।’ প্রশংসা নয় অবশ্যই।

সে দিনের ‘ভিটন জেনারেশন’ আজকের ‘গোল্ডেন জেনারেশন’। একটা সময় বেলজিয়াম নিয়ে সেরা ঠাট্টাগুলোর একটা হল, তুমি সেরা দশ বেলজিয়ানের নাম করতে পারবে না। টিনটিনের স্রষ্টা হার্জ, আগাথা ক্রিস্টির কাল্পনিক গোয়েন্দা-চরিত্র পয়রোয় এসে আটকে যেতে হবে। কিন্ত আজ আর তা বলা যায় কি?

শুধু ফুটবলেই তো এখন দিব্য সেরা দশ বেজলিয়ান পাওয়া যাচ্ছে। সরি, এগারো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন