সোনা জিতে দেশে ফিরে একান্ত সাক্ষাৎকারে মেরি কম

‘এই সোনাটা কিছু লোককে জবাবও’, আবেগাপ্লুত মেরি কম

তিন ছেলের মা। বয়স ৩৫। রাজ্যসভার সাংসদ। তবু বক্সিং রিংয়ে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে কমনওয়েলথ গেমসে সোনার পদক জয়। ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে তিনি এক চলমান রূপকথা। অলিম্পিক্স, এশিয়ান, কমনওয়েলথ— তিনটি গেমস থেকেই পদক জেতা হয়ে গেল। পাঁচ বার বিশ্ব খেতাব জিতেছেন। গোল্ড কোস্ট থেকে মঙ্গলবার সকালেই ভারতে ফিরে মোবাইল ফোনে আনন্দবাজারের মুখোমুখি মেরি কম। দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে ধরা দিলেন এক অজানা, অচেনা কিংবদন্তি! পাঁচ বার বিশ্ব খেতাব জিতেছেন। গোল্ড কোস্ট থেকে মঙ্গলবার সকালেই ভারতে ফিরে মোবাইল ফোনে আনন্দবাজারের মুখোমুখি মেরি কম।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:২৩
Share:

লড়াকু: এখনই অবসর নয়, দেশকে গর্বিত করে যেতে চান মেরি। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: কমনওয়েলথ গেমসে প্রথম সোনা। আপনি কতটা খুশি?

Advertisement

মেরি কম: ভীষণ, ভীষণ খুশি। বলে বোঝাতে পারব না, আমি কতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম সোনাটা জিতে। এত ব্যস্ত সূচি, পাল্টে যাওয়া জীবনের স্রোত সামলে সোনাটা জিততে হয়েছে। সেই কারণে এটা আরও বেশি সুখের।

প্র: কতটা কঠিন ছিল এই যাত্রা?

Advertisement

মেরি: কমনওয়েলথে সোনা জেতা মোটেই সহজ নয়। কেউ আমার হাতে সোনাটা পুরস্কার হিসেবে তুলে দিতে আসেনি। তার উপর আমার পাল্টে যাওয়া জীবন। আগের সেই যুবতী মেরি কম তো আর নেই যে, শুধু রিংয়েই পড়ে থাকছে। তিন সন্তানের মা আমি। ঘর-সংসারী হয়ে গিয়েছি (হাসি)। অন্যান্য কাজ থাকে। বক্সিং রিং ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে এমন একটা সোনা জিতলাম, যেটা আগে কখনও পাইনি। সফল হতে পেরেছি অনেকে আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে। বিএফআই (বক্সিং ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া) কর্তারা এবং সংস্থার কোচেদের কথা বলতে চাই। ওঁরা না-থাকলে এই সোনাটা জেতা হত না। আমার স্বামী, সন্তানদের ভালবাসা আর আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে থাকবে এই সোনার পদক।

প্র: আপনার এই দুরন্ত প্রত্যাবর্তন কী করে সম্ভব হল, সেটা বলুন।

মেরি: আমি জানতাম, ফিরে এসে আগের মতো সাফল্য পাওয়া সহজ হবে না। সেই কারণে আরও বেশি করে মনঃসংযোগ করতে হয়েছিল। দু’বেলা ট্রেনিং করতাম। সকালে আর সন্ধেয়। যে কাজেই ব্যস্ত থাকি না কেন, ট্রেনিং সূচির সঙ্গে কখনও আপস করিনি। নিজের জীবন থেকেই তো জানি, সাফল্যের কোনও ছোটখাটো, ভিতরকার রাস্তা হয় না। আমি জানতাম, আগের সেই অল্পবয়সি মেরি আর নেই। পঁচিশ বছরে যা পারতাম, সেটা কি আর পঁয়ত্রিশে এসে পারব?

প্র: নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার প্রতিজ্ঞাও কি ছিল?

মেরি: অবশ্যই ছিল। কত লোকে বলেছিল, এই বয়সে রিংয়ে ফিরে এসে কী করবে ও? আর কখনও কি পদক জিততে পারবে? সারা জীবন আমি দেশের পতাকা বুকে জড়িয়ে ধরে বক্সিং রিংয়ে লড়ে গিয়েছি। দেশকে গর্বিত করার চেষ্টা করেছি। আর এই লোকগুলো হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে এসে আমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে! যেন আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে ওরাই।

প্র: পদক জেতার পরে কী বলতে ইচ্ছে করছে ওই লোকগুলোকে?

মেরি: বলতে ইচ্ছে করছে যে, আরে ভাই, কিছু সাফল্য তো আমিও পেয়েছি। তার জন্য হাততালি না দিতে পারিস, তোরা অন্তত চুপ করে থাক। সেটাও এক ধরনের সম্মান দেখানো। ওরা বলছিল, এখন নাকি আমার পরিবারের সঙ্গে জীবন উপভোগ করার সময়। ওদের কে বোঝাবে যে, জীবনের রাস্তায় লড়াইয়ের কোনও বয়ঃসীমা হয় না!

প্র: সোনা জয় কি সেই লোকগুলোর জন্যও বিশেষ বার্তা?

মেরি: অবশ্যই। দ্যাখ তোরা যে, লড়াইয়ের কোনও বয়স হয় না। শেখ তোরা যে, ইচ্ছা থাকলে দুর্গম পথ জয় করা যায় পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, যা খুশি বলে দিতে পারে যেন। কুছ ভি! আর এমন ভাব করছিল যেন এটা ওদের অধিকারের মধ্যে পড়ে! অসহ্য!

প্র: কারা এই লোকগুলো?

মেরি: থাক, আমি কারও নাম করতে চাই না। কমনওয়েলথ গেমসে যাওয়ার আগেও ওরা সারা ক্ষণ বলে গিয়েছে, মেরি কেন গেমসে যাচ্ছে? ওকে আর কেন প্রতিযোগিতায় নামতে দেওয়া হচ্ছে? নিজেকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করতাম যে, এদের নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার দরকার নেই, মেরি। কিন্তু মাঝেমধ্যে বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না। দুঃখ পেতাম। হতাশ লাগত। নিজেকে প্রশ্ন করতাম— মেরি, এটাই কি তোমার প্রাপ্য? গোল্ড কোস্টে সোনাটা জেতার পরে খুব আনন্দ হয়েছিল। নিজেকে বলেছিলাম, যোগ্য জবাব দিয়েছ। ওই লোকগুলো আজকের দিনটা অন্তত চুপচাপ থাকবে।

প্র: সোনা নিয়ে দেশে ফেরার পরে এখন কী মনে হচ্ছে?

মেরি: এখন অবশ্য মনে হচ্ছে, যাক গে যাক। ওদের অত গুরুত্ব না দিলেও চলবে। আমার কাজ তো ওদের বোঝানো নয়। আমার কাজ, প্রমাণ করা যে, আমি এখনও সেরা হতে পারি। সারা দুনিয়া আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই এক বা দুই শতাংশ লোক কী বলল, তা দিয়ে সত্যি কী এসে যায়? কমনওয়েলথে সোনা জিতেছি, তা দেখে যদি ওদের শিক্ষা হয়! ভারতের পুরুষ ও মহিলা দল বক্সিংয়ে এত ভাল ফল করেছে— এটাই দারুণ খবর। বক্সিং ফেডারেশন খুব পাশে দাঁড়াচ্ছে আমাদের। সেটা ভবিষ্যতে আরও ভাল ফল করতে উৎসাহিত করবে। মন্ত্রিসভা থেকে সাহায্য পেয়েছি। সাই (স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়া) পাশে দাঁড়িয়েছে। কোচেরা সারা ক্ষণ উৎসাহ দিয়েছেন। কমনওয়েলথে বক্সিংয়ের সাফল্য ঐতিহাসিক দলগত সাফল্য।

প্র: পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, তিন সন্তানের মা হয়েও নিজেকে এত লড়াকু রাখতে পারার রহস্য কী?

মেরি: সলমন খানের ‘ওয়ান্টেড’ ফিল্মের বিখ্যাত সংলাপটা জানেন তো? ‘এক বার যো ম্যায়নে কমিটমেন্ট কর দি উসকে বাদ তো ম্যায় খুদ কি ভি নহি সুনতা’— আমারও মনে কথা এটাই (হাসি)। এক বার আমি বলে দিয়েছি রিংয়ে ফিরব মতলব, রিংয়ে ফিরতেই হবে। নিজের কথাও আর শোনা যাবে না। ঈশ্বর আমাকে ইচ্ছাশক্তিটা দিয়েছেন। সেটার জোরেই হয়তো পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও পদক জিতছি। আমি ফলাফলেরও আগে কর্মে বিশ্বাসী। যদি কর্মটা ঠিকঠাক করা যায়, সুফল আসবেই। সেই কারণে অনুশীলনের উপর খুব জোর দিয়েছিলাম।

প্র: ট্রেনিংয়ে বিশেষ কিছু করেছেন? খাদ্যাভ্যাসেও নিশ্চয়ই অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে?

মেরি: বক্সিং ফেডারেশনের কোচেদের অধীনেই ট্রেনিং করেছি। ওঁরা যখন যে রকম বলেছেন, তেমনই করেছি। বক্সিংয়ে এখন আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রিংয়ে পড়ে থাকার ট্রেনিং হয় না। এখন এসে গিয়েছে ‘স্মার্ট ট্রেনিং’। এটা বর্ণনা করা কঠিন। আপনি যখন আমাদের ট্রেনিংয়ে আসবেন, বুঝিয়ে দিতে পারব। সংক্ষেপে বলি, টেকনিক নির্ভর ট্রেনিং পদ্ধতি এটা। আর খাদ্য নিয়ে খুব বেশি বিধিনিষেধ নেই। লড়াই না-থাকলে অনেক কিছুই খাই।

প্র: কমনওয়েলথের এই সোনা জয় আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

মেরি: ভীষণ, ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমি বাকি দু’টো গেমস থেকে আগে পদক জিতেছি। অলিম্পিক্স আর এশিয়ান গেমসের পদক দু’টো রাখা আছে পাশাপাশি। কমনওয়েলথ গেমসের পদক ছিল না। এ বার গেমসের পদক জেতায় বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল আমার। অলিম্পিক, এশিয়ান, কমনওয়েলথ গেমস।

প্র: ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন? সামনে এশিয়ান গেমস আছে, ২০২০-তে আছে অলিম্পিক্সও। আপনাকে কি টোকিওয় দেখা যাবে?

মেরি: আপাতত সামনে যে-সব প্রতিযোগিতা আছে, সেগুলি নিয়েই ভাবব আমি। দূরের লক্ষ্য নিয়ে এখনই ভাবছি না। সেগুলো কোচেদের সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করে করব। পঁয়ত্রিশ বছরে আমার শরীর কোন ধরনের অনুশীলন নিতে পারবে, সেটা ওঁরাই ভাল বুঝতে পারবেন। সেই মতো চলতে হবে।

প্র: যখন শোনেন, গোটা দেশের উঠতি কিশোর-কিশোরীদের বলা হচ্ছে মেরি কমকে উদাহরণ করো, কেমন অনুভূতি হয়?

মেরি: অসম্ভব তৃপ্ত লাগে। মনে হয়, জীবনে যে সংগ্রাম করেছি, সেটাকে ওঁরা সম্মান দেখাচ্ছেন। যদি সত্যিই কারও সামনে অনুপ্রেরণা হতে পারি খেলোয়াড় হিসেবে, তার চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু নেই। সেটাই হয়তো সব চেয়ে বড় পদক।

প্র: সংসারী, মা, সাংসদ। আবার সোনার পদকজয়ী। বক্সার মেরি কমের জীবনকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?

মেরি: বলতে পারেন, খুব ভাল একটা সফরের মধ্যে আছি। ‘জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা’ (হাসি)। পরিবার ও বক্সিং, দু’টো দিক সামলে চলা সহজ নয়। তবে কী জানেন, জীবনের চলার পথে যদি এগিয়ে চলার ইচ্ছাশক্তিটা থাকে, কোনও না কোনও রাস্তা ঠিক বেরিয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন