ভারতীয় অ্যাথলিটদের প্রেরণা হোক অঞ্জু, বার্তা কিংবদন্তি পাওয়েলের

‘লুইসের মতো শত্রু ছিল বলেই বিশ্বরেকর্ড হয়েছে’

অলিম্পিক্স সোনা না জিতেও কেউ কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন, সেটা দেখিয়েছিলেন তিনি— মাইকেল অ্যান্টনি পাওয়েল। সেই অতিমানব মার্কিন লং জাম্পার বৃহস্পতিবার কলকাতায় এলেন ‘টাটা স্টিল কলকাতা ২৫ কে’ দৌড়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে।

Advertisement

কৌশিক দাশ

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:০৪
Share:

বিস্ময়: সব মাথা ছাড়িয়ে। ধর্মতলার রাস্তায় কিংবদন্তি মাইক পাওয়েলকে দেখে অবাক পথচারীরা। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

একটা লাফ তাঁকে অ্যাথলেটিক্সের দুনিয়ায় অমর করে দিয়েছে। ওই একটা লাফ ভেঙে দিয়েছিল বব বিমনের তেইশ বছরের রেকর্ড। অলিম্পিক্স সোনা না জিতেও কেউ কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন, সেটা দেখিয়েছিলেন তিনি— মাইকেল অ্যান্টনি পাওয়েল। সেই অতিমানব মার্কিন লং জাম্পার বৃহস্পতিবার কলকাতায় এলেন ‘টাটা স্টিল কলকাতা ২৫ কে’ দৌড়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর হয়ে। সারা দিনের প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও আনন্দবাজার-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে যা বললেন মাইক পাওয়েল।

Advertisement

প্রশ্ন: মাইক পাওয়েল নামটা শুনলেই ভেসে ওঠে ১৯৯১ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সেই লাফ। যা ভেঙে দেয় বব বিমনের ২৩ বছরের রেকর্ড (৮.৯০)। কখনও কি ভেবেছিলেন, ৮.৯৫ মিটার লাফিয়ে বিশ্বরেকর্ড করবেন?

মাইক পাওয়েল: বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে যখন নামি, তখন আমার লক্ষ্য ছিল নিজেকে সেরা প্রতিষ্ঠা করা। তার আগে সোল অলিম্পিক্সে সোনা হারিয়েছি। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম, কার্ল লুইসকে এখানে হারাতেই হবে। ও আমার আগে লাফ দিচ্ছিল। ৮.৯১ মিটার লাফিয়ে বুকটা চাপড়াচ্ছিল। আমার দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল। আমি তখনই ঠিক করে নিই, ওকে হারাবই।

Advertisement

প্র: তা হলে বিমনের রেকর্ডটা আপনার মাথায় ছিল না?

পাওয়েল: সত্যি বলতে তখন বিমনের নামটাও ভুলে গিয়েছিলাম। একটা কথা বলে যাচ্ছিলাম নিজেকে। কার্লকে হারাতেই হবে। তার পর দৌড় শুরু করলাম। নিজেকে শূন্যে ভাসিয়ে দিলাম। বাকিটা পৃথিবী দেখেছে।

প্র: কার্ল লুইস। আপনার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। যার জন্য আপনার অলিম্পিক্স সোনা পাওয়া হয়নি। কার্লকে দেখে কি আপনি উদ্বুদ্ধ হতেন? না কি শত্রু হিসেবে ঘৃণা করতেন?

পাওয়েল: আমি শুরুর দিকে কার্লকে আদর্শ হিসেবেই দেখতাম। কিন্তু তার পরে দেখলাম, ওকে নিয়ে সবাই বড্ড বেশি মাতামাতি করছে। ওকে বিশাল উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। তখন নিজেকে বলি, ওহে অনেক হয়েছে। এ বার একে টেনে নামানোর সময় হয়েছে। ওকে হারিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমিও ফ্যালনা নই। তখন থেকেই ওকে শত্রু হিসেবে দেখতে শুরু করি।

প্র: সেই শত্রুতা থেকেই কি অদম্য জেদের জন্ম?

পাওয়েল: অবশ্যই। আমি নিজেকে তৈরি করতে শুরু করলাম তিলে তিলে। এমন একটা জায়গায় নিজেকে নিয়ে গেলাম, যখন কার্লের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারলাম, এ বার তোমাকে হারিয়ে দেখাব। তার পর এল ওই বিশেষ দিনটা। টোকিও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে।

প্র: যখন বিশ্বরেকর্ডটা হল, কী মনে হচ্ছিল আপনার?

পাওয়েল: প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। ২৬ বছর আগের কথা। কিন্তু এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ওয়াহ! আসলে আপনি যখন একটা জিনিস খুব মন দিয়ে চান, তার জন্য সব কিছু ত্যাগ করেন, কঠোর পরিশ্রম করেন...আর সেটা শেষ পর্যন্ত যখন আপনার মুঠোয় আসে...তখন সেই অনুভূতিটা বলে বোঝানো যায় না।

প্র: বব বিমনের রেকর্ড টিকে ছিল ২৩ বছর। ২৬ বছর হয়ে গেল আপনার রেকর্ডের ধারেকাছে আসতে পারেনি কেউ। কী মনে হয়, কেউ আপনার রেকর্ড ভাঙতে পারবে?

পাওয়েল: সত্যি বলতে কী, আমি কখনও ভাবিনি আমার রেকর্ড এত দিন অক্ষত থাকবে। সম্মানিত লাগছে। আমি যখন নামতাম, তখন অ্যাথলিটদের মান এতটাই উঁচু ছিল যে ওদের কাউকে হারাতে গেলে এ রকম একটা কিছু অতিমানবীয় কাণ্ড করতেই হতো। না হলে ওদের হারানো যেত না। একজন তখনই নিজেকে ছাপিয়ে যেতে পারে, যখন তার সামনে আর একজন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে।

প্র: যেমন আপনার সামনে কিংবদন্তি কার্ল লুইস ছিল?

পাওয়েল: একদম ঠিক। ওকে শত্রু হিসেবে দেখলেও আমরা একে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করতাম।

প্র: বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স, অলিম্পিক্স অবিশ্বাস্য সব পারফরম্যান্স দেখেছে। যেমন বিমনের রেকর্ড ভাঙা। ইউসেইন বোল্টের সোনার হ্যাটট্রিক। লুইসের এক অলিম্পিক্সে চার ইভেন্টে সোনা। নাদিয়া কোমানিচির পারফেক্ট টেন। আপনাকে যদি সর্বকালের সেরা পারফরম্যান্স বাছতে বলা হয়, তা হলে কোনটা আগে রাখবেন?

পাওয়েল: (একটু ভেবে) বোল্টের কৃতিত্ব। ২০০৮ সালে বোল্ট যখন ৯.৬৯ সেকেন্ডে দৌড়ে বিশ্বরেকর্ড করে ফিনিশিং লাইনের আগে বুকটা চাপড়াল (নিজের বুকটা একবার চাপড়ে দিয়ে)..ওহ ম্যান, ভোলা যায় না। তার পরেও আবার বিশ্বরেকর্ড। ২০০৯ বার্লিন। ওর কৃতিত্বকে আগে রাখতেই হবে। তবে আমি মাইকেল জনসনের কথাও বলব। চারশো মিটারে বিশ্বরেকর্ডও দারুণ কৃতিত্বের।

প্র: আপনার চোখে সর্বকালের সেরা তিন অ্যাথলিট কে?

পাওয়েল: সেরা তিন হল জেসি ওয়েন্স, কার্ল লুইস, ইউসেইন বোল্ট। প্রথম দু’জন স্প্রিন্টের সঙ্গে জাম্পটাও দিত। অলরাউন্ড অ্যাথলিট। বোল্টের চেহারাটা লং জাম্পের উপযোগী হলেও ও ওই ইভেন্টটা বাদ দিয়ে গিয়েছে। ও লং জাম্পে নামলে হয়তো আমার রেকর্ড ভেঙে দিত। হয়তো ন’ মিটারের গণ্ডিও টপকে যেত।

প্র: আপনি লং জাম্পে বিশ্বরেকর্ডের মালিক হলেও অলিম্পিক্সে রুপো জিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। কখনও কি মনে হয়, আমার বিশ্বরেকর্ডের বদলে যদি অলিম্পিক্স সোনা পেতাম, তা হলে ভাল হতো?

পাওয়েল: একটা সময় অলিম্পিক্স সোনা হারানোর জন্য খুব আফসোস হতো। কিন্তু এখন, এত বছর পরে এসে মনে হয়, সোনা জিতিনি তো কী হয়েছে, বিশ্বরেকর্ডটা তো আমার। এটা এখনও কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেনি। এর গুরুত্ব অনেক বেশি।

প্র: এখন যাদের অলিম্পিক্সে লাফাতে দেখেন, তাদের দেখে কী অনুভূতি হয়?

পাওয়েল: ওদের প্রতি আমার শুভেচ্ছা রইল। ওরা নিশ্চয়ই ভাল করছে। কিন্তু ওদের দেখলে আমার হিংসেও হয়।

প্র: হিংসে! কেন?

পাওয়েল: আমি যখন লড়তাম, আমার প্রতিন্দ্বন্দ্বী ছিল কার্ল লুইসের মতো অ্যাথলিট। আমি যে দূরত্বে লাফাতাম, তাতে ১৯৯৬ সালের পর থেকে নামলে যে কোনও অলিম্পিক্সে সোনা জিততাম।

(প্রসঙ্গত, ২০১৬ রিও অলিম্পিক্সে লং জাম্পে সোনাজয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জেফ হেন্ডারসন লাফান ৮.৩৮ মিটার)।

প্র: ভারতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের কথা বললে আপনার মনে কোন নামটা ভেসে ওঠে?

পাওয়েল: (এ বারও একটু ভেবে) অ্যাঞ্জু, অ্যাঞ্জু।

প্র: মানে অঞ্জু ববি জর্জ?

পাওয়েল: হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে লং জাম্পে ব্রোঞ্জ পেয়েছিল। ও কিন্তু আপনাদের উঠতি অ্যাথলিটদের কাছে রোল মডেল হতে পারে।

প্র: ভারতে কিন্তু ক্রিকেট প্রচণ্ড জনপ্রিয়।

পাওয়েল: আমি জানি সেটা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার ক্রিকেট দেখা হয় না, খোঁজখবরও রাখা হয় না।

প্র: ভারতের পক্ষে কি অলিম্পিক্স পর্যায়ের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলিট তৈরি করা সম্ভব?

পাওয়েল: আপনাদের এত বড় দেশ, এত জনসংখ্যা। এদের মধ্যে প্রতিভা থাকবে না, তা হয় নাকি? এদের খুঁজে বার করতে হবে, স্বপ্ন দেখাতে হবে। সে জন্যই আমি এ ভাবে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। চেষ্টা করি আমার নিজের কাহিনি বলার। তাতে যদি কেউ উদ্বুদ্ধ হয়।

প্র: ভারতীয় অ্যাথলিটদের জন্য আপনার কী টিপস থাকবে?

পাওয়েল: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা ছোটবেলা থেকেই বড় স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, উঁচু জায়গায় পৌঁছনোর কথা ভাবতে ভালবাসি। আমার পরামর্শ হল, তোমরা নিজেকে প্রশ্ন করো— ওই লোকটা যদি পারে, তা হলে আমি পারব না কেন? নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে যাও, সাফল্য আসবেই।

প্র: আপনি এই নিয়ে তৃতীয়বার ভারতে এলেন। আমাদের দেশের কোন বিশেষ খাবার আপনার মনে ধরেছে?

পাওয়েল: বাটার চিকেন। এমনিতে আমি বেশ মশলা খাই। তবে আপনাদের এখানকার মশলা নয়।

প্র: শেষ প্রশ্ন। ভারতের কী আপনার সবচেয়ে ভাল লাগে?

পাওয়েল: বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাদের এখানে দেখতে পাওয়া যায়। সিরিয়াসলি! হা হা করে হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা মানুষটা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন