লড়াইয়ের দ্যুতিতে আলোর আভা

কেউ তাঁর দিকে সরাসরি আঙুল তোলেনি কখনও। কোনও পরীক্ষাতেও ধরা পড়েননি। তবুও কটূক্তি বা কটাক্ষ শুনতে হতো মাঝেমধ্যে। দেশের অন্যতম সেরা অ্যাথলিট দ্যুতি চন্দ ছেলে না মেয়ে, তা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৭ ০৩:৫৩
Share:

লড়াই: সল্টলেক সাইয়ে পিঙ্কির সঙ্গে আভা। নিজস্ব চিত্র

কেউ তাঁর দিকে সরাসরি আঙুল তোলেনি কখনও। কোনও পরীক্ষাতেও ধরা পড়েননি। তবুও কটূক্তি বা কটাক্ষ শুনতে হতো মাঝেমধ্যে।

Advertisement

দেশের অন্যতম সেরা অ্যাথলিট দ্যুতি চন্দ ছেলে না মেয়ে, তা নিয়ে দেশজুড়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল। চোখের সামনে দেখেছেন পিঙ্কি প্রামাণিকের হেনস্তা হওয়া। আর এ সব দেখেই ভয়ে ফিরে গিয়েছিলেন জঙ্গলমহল সংলগ্ন গ্রাম খুরশিতে।

কিন্তু ফেসবুকের বন্ধুত্ব বাংলার অন্যতম প্রতিশ্রুতিমান অ্যাথলিট আভা খাটুয়াকে ফিরিয়ে এনেছে অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাকে। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাকে ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন দ্যুতি চন্দ স্বয়ং।

Advertisement

‘‘দ্যুতি বা পিঙ্কিদির মতো আমাকে একই রকম দেখতে বলে অনেকে ফিসফাস করত। যা শুনতে আমার খারাপ লাগত। যদি সত্যিই অন্য কিছু হয় তা হলে তো গ্রামে মুখ দেখাতে পারব না। এই ভয়ে অ্যাথলেটিক্স থেকে দূরে চলে গিয়েছিলাম।’’ বৃহস্পতিবার সল্টলেক সাইতে অনুশীলনে নামার আগে কথা বলতে বলতে কৃষক পরিবারের সন্তান আভার গলায় উদ্বেগ ধরা পড়ে। তারপর সুভাষ সরকারের ছাত্রী বলে চলেন, ‘‘এর পর দ্যুতির সঙ্গে ফেসবুকে আলাপ হয়। ওই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে মাঠে ফেরার জন্য। নিয়মিত কথা হয় ওর সঙ্গে। দ্যুতি যদি সব বিতর্ক সরিয়ে আন্তর্জাতিক পদক পায় তা হলে আমি পাব না কেন? ওটাই আমার লক্ষ্য।’’ বাংলার ‘দ্যুতি’-র জেদ ফুটে বেরোয় এ সব কথা বলার সময়।

আরও পড়ুন: জীবনের সেরা ইনিংস খেলে রাজধানীতে ঋষভ উদয়

রাজ্য অ্যাথলেটিক্স সংস্থার সচিব কমল মৈত্র বলছিলেন, ‘‘কিছু লোক ওকে ভুল বুঝিয়েছিল। ভয় দেখিয়েছিল। সে জন্য ফিরতে ভয় পাচ্ছিল। আমরা তো ওকে রাজ্য প্রতিযোগিতায় নামতে দিচ্ছি। কোনও বিতর্ক নেই ওকে নিয়ে।’’

দ্যুতির সঙ্গে আভার ইভেন্টের অবশ্য কোনও মিল নেই। শক্তপোক্ত চেহারার আভার ইভেন্ট জ্যাভলিন থ্রো। সদ্য শুরু করেছেন হেপ্টাথলন। বিতর্কের ভয়ে প্রায় তিন বছর নিজেকে সরিয়ে নিলেও আভার গ্রামের ভাঙা কাঠের আলমারিতে জাতীয়, পূর্বাঞ্চলীয়, রাজ্য এবং সর্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা মিলিয়ে নানা ইভেন্টের অন্তত আঠাশটি পদক!

‘‘যেখানে যখন নেমেছি সেখানেই প্রায় পদক পেয়েছি। আবার অনুশীলনে নামলেও মনে হয় তা বন্ধ করে দিতে হবে। খাওয়ার পয়সাই তো নেই। পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে দিনরাত দু’বেলাই রুটি-তরকারি খেয়ে আসি। অনুশীলনের পর মুড়ি খাই। জ্যাভেলিন থ্রোর জন্য যে রকম জুতো দরকার, সেটাও তো নেই।’’

বাবা-মা-দাদা ভাগচাষি। নিজেও ছোটবেলায় চাষের কাজ করতেন আভা। কলকাতায় এলে থাকেন সল্টলেকের যুব আবাসের ডরমেটরিতে। সারাদিন অনুশীলনের পর যেখানে ফিরে বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগ নেই। সারা দিন হইচই। বলছিলেন, ‘‘স্যার তো বলছেন পুষ্টিকর খাবার খাওয়া দরকার। কিন্তু কোথায় পাব? অর্ধেক দিন তো না খেয়েই থাকি। বাবা কিছু টাকা পাঠায়। বাকিটা চেনা-জানা লোকের কাছে ভিক্ষা করে পয়সা চেয়ে কিনি।’’

এত কষ্টের মধ্যেও স্নাতক হওয়ার থার্ড ইয়ারের পরীক্ষায় বসেছেন। এত কষ্ট এবং কটূক্তি শুনেও কেন পড়ে রয়েছেন অ্যাথলেটিক্সে? আভার উত্তর, ‘‘এটা আমার জেদ বলতে পারেন। আমি দেখাতে চাই গরিব ঘরের মেয়েরাও আন্তর্জাতিক পদক জিততে পারে। সফল হয়।’’ এত দুস্তর বাধা পেরিয়ে আভার জীবনে সাফল্যের আভা ফেরে কি না সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন