সুযোগ পেয়েও শহিদ হওয়া হল না আর্মান্দোর

মাঠের মধ্যে তখন ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। যাঁকে সামনে পেলেন শুভেচ্ছা জানালেন। হাত মেলালেন। জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু তেমন প্রত্যুত্তর পেলেন কোথায়? বিদায়বেলায় র‌্যান্টি, ডুডু, লালরিন্দিকারা তাঁর সঙ্গে এমন কোনও আবেগী আচরণ করলেন না, যা দেখে মনে হতে পারে তাঁর ফুটবলারদের কারও সামান্যতম দুঃখ রয়েছে! ক্লাবের সমর্থকরাও তো তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাঠ থেকে গ্যালারির দিকে হাত নাড়লেন। কিন্তু গ্যালারি থেকে পাল্টা কাউকে তো হাত নাড়তে দেখা গেল না!

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪১
Share:

ডার্বিতে বাগানের গোল। মঙ্গলবার যুবভারতীতে। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

মোহনবাগান ১ (বোয়া)

Advertisement

ইস্টবেঙ্গল ১ (র‌্যান্টি)

Advertisement

মাঠের মধ্যে তখন ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি। যাঁকে সামনে পেলেন শুভেচ্ছা জানালেন। হাত মেলালেন। জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু তেমন প্রত্যুত্তর পেলেন কোথায়?

বিদায়বেলায় র‌্যান্টি, ডুডু, লালরিন্দিকারা তাঁর সঙ্গে এমন কোনও আবেগী আচরণ করলেন না, যা দেখে মনে হতে পারে তাঁর ফুটবলারদের কারও সামান্যতম দুঃখ রয়েছে!

ক্লাবের সমর্থকরাও তো তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মাঠ থেকে গ্যালারির দিকে হাত নাড়লেন। কিন্তু গ্যালারি থেকে পাল্টা কাউকে তো হাত নাড়তে দেখা গেল না!

ডেম্পো থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল ‘কলঙ্কের বোঝা’ মাথায় নিয়ে। নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল গোয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলায় এসে ইস্টবেঙ্গল থেকে বিদায়ের দিনটাও যে এত শীতল হবে তাঁর বোধহয় ভাবতে পারেননি আর্মান্দো কোলাসো।

শেষ তিন ম্যাচে মাত্র দু’পয়েন্ট কোচের জন্য কাঁদবেই বা কেন লাল-হলুদ জনতা! অথচ আর্মান্দোর কাছে মঙ্গলবারের ডার্বি ছিল শহিদ হয়ে বিদায় নেওয়ার সেরা সুযোগ। বড় ম্যাচ জিতে গোয়া পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হল কই?

যেমন হল না সঞ্জয় সেনেরও। জীবনের প্রথম ডার্বি জিতে মহাতারকা কোচ হওয়ার সিঁড়িতে প্রথম পদক্ষেপ ফেলার সুযোগ ছিল চেতলার বাঙালির।

বেঙ্গল আর বাগানের দুই কোচের কেউই একান্ত ব্যক্তিগত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। দু’জনেই এমন কিছু কোচিং প্রজ্ঞা দেখাতে পারেননি মঙ্গল-সন্ধের যুবভারতীতে যা নিয়ে শিবরাত্রিতে বাংলার মানুষ কয়েক ঘণ্টা ফুটবল-আড্ডায় মশগুল থাকতে পারে।

সাড়ে চার বছর ট্রফি না পাওয়া মোহনবাগান ক্লাবের কোচের কাছে এ দিনের অমীমাংসিত ডার্বির পরে অবশ্য কিছু হারানোর নেই। কিন্তু আর্মান্দোর কাছে তো ছিলই। ইস্টবেঙ্গলের দীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম বার কোনও কোচ ডাবির্র্-যুদ্ধে নেমেছিলেন আগেই নিজের চাকরি খুইয়ে। এ দিন সকালেই এলকো সতৌরিকে কলকাতায় এনেও লুকিয়ে রাখেন লাল-হলুদ কর্তারা। যুবভারতীতে আনেননি চিরদিনের আবেগের ম্যাচে বিতর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে সেই আশঙ্কায়।

যদিও ক্লাব সূত্রের খবর, হোটেলে নিজের ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখেছেন ইস্টবেঙ্গলের আগামী ডাচ কোচ। তবে বন্ধ করে রাখেন তাঁর মোবাইল। যদিও এক বছর পর বঙ্গ ফুটবলে প্রত্যাবর্তনের আনন্দ এলকো পুরোপুরি সামলাতে পারেননি। নিজের হোয়াটসঅ্যাপে লাল-হলুদ লাগিয়ে দিয়েছেন। ফেসবুকে তাঁর ইস্টবেঙ্গলে কোচ হয়ে আসার বিভিন্ন ওয়েবসাইট খবর ট্যাগ করেছেন। কোচ বদল নিয়ে যত লুকোচুরিই খেলুন ইস্টবেঙ্গল কর্তারা, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট ব্যবহার করে সেটা কার্যত বানচাল করে দেন প্রাক্তন ইউনাইটেড কোচ স্বয়ং সতৌরি-ই। এবং সেই সব যে আর্মান্দোর কানে যায়নি তাও নয়। কিন্তু ক্লাবের অন্দরে বড় ম্যাচের আগেই তাঁর এমন দশা ছিল যে, তিনি গাইতেই পারতেন, “বড় একা লাগে এই আঁধারে...”।

প্রায় দেড় বছর কোচিং করানোর পরে ইস্টবেঙ্গল থেকে কার্যত মাথা নিচু করে বিদায় নিতে হচ্ছে তাঁকে। তবে এ দিনও র্যান্টি-ডুডুদের গোল নষ্টের সময় তাঁকে যেমন দেখা গিয়েছে মাথা চাপড়াতে, তেমনই প্রথমে গোল হজম করে হতাশায় রিজার্ভ বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়েন। রেফারির সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে চিৎকার করেছেন।

ম্যাচটা অবশ্য কোনও সময়ই মনে হয়নি দুই প্রধানের কেউ জিতবে। জোড়া ডিফেন্সিভ ব্লকার থেকে রক্ষণ সংগঠনআর্মান্দো বা সঞ্জয় দুজনই সর্বদা চেষ্টায় ছিলেন আগে নিজের ঘর বাঁচিয়ে পরে অন্যের ঘর ভাঙার। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নিরামিষ ড্রয়ে শেষ ডার্বি। এক পয়েন্ট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকল দুই প্রধানই। যা দেখে গত বারের চ্যাম্পিয়ন বেঙ্গালুরু কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউড তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে ভিআইপি গ্যালারি থেকে নেমে গেলেন।

আই লিগের মরাবাজারেও হাজার পঞ্চাশেক দর্শক এসেছিলেন কলকাতা ডার্বির চিরকালীন উত্তেজনা উপভোগ করতে। এ-পাড়া, ও-বাড়ির নামাঙ্কিত অসংখ্য লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন পতাকাও দুলেছে গ্যালারি বেয়ে। পটকাও ফেটেছে। প্রিয়তম দলের গোলের সময় সমর্থকেরা পাগলের মতো নেচেছেন আবার গোল হজম করে হয়েছেন চরম বিমর্ষ। তবে সেই মেয়াদও তো ছয় মিনিটের মধ্যেই শেষ! মোহনবাগানের ১-০ থেকে ইস্টবেঙ্গলের ১-১ তো ওই কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

খেলার পর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের কোচ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির হাসি হেসেছেন। গ্যালারিতে অবশ্য উল্টো ছবি। দুই ক্লাবের সমর্থকেরাই নিজেদের দলকে দুষেছেন মাঠে জেতার চেষ্টা না করার জন্য। প্রশ্ন উঠেছে আর কত দিন এই ফুটবল দেখব? কেন দেখতে আসব?

বিশ্ব ফুটবলে সেটপিস এখন বড় অস্ত্র সব দলেরই। দেখা যাচ্ছে, ষাট ভাগ গোল এখন আসছে কর্নার বা ফ্রি-কিক থেকে। কলকাতার ফুটবলে এটা কমে আসছিল। আই লিগের প্রথম ডার্বি সেটা অন্তত কিছুটা পুষিয়ে দিল। চোখের আরাম দিয়ে। প্রথমার্ধে বোয়া এবং র‌্যান্টির গোল আর পাল্টা গোল দুটোই প্রায় একই রকম। কর্নার থেকে পাওয়া বলের ফসল হেডে তুললেন দুই বিদেশিই। দুই বিদেশির হেডে যদি গোলের দরজা খুলে থাকে এ দিন, তা হলে তার আগে দুই বঙ্গসন্তানের হাতে গোলদ্বার রক্ষা পেয়েছে দুই প্রধানেরই। বাগান কিপার শুরুর মিনিটেই র্যান্টির শট না আটকালে বা বোয়ার মারাত্মক শট অভিজিৎ অবিশ্বাস্য দক্ষতায় না আটকালে অন্য রকম কিছু ঘটতেই পারত দুই প্রধানের কপালে। তবে গোল হজমের ক্ষেত্রেও দুই কিপারই কম-বেশি দায়ী।

বিদায়বেলায় আর্মান্দো হঠাৎ সাহস দেখালেন আইএসএলের সেরা স্টপার অর্ণব মণ্ডলকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসিয়ে রেখে টিম নামিয়ে। সঞ্জয় আবার তাঁর প্রথম ডার্বিতে বড় চেহারার আনোয়ারকে বসিয়ে রেখে ডুডু-র‌্যান্টিকে আটকানোর জন্য ডিফেন্সে ভরসা রাখলেন কিংশুক দেবনাথের উপর। তবে দু’টো সিদ্ধান্তই কাজে ভুল প্রমাণিত। ওঁদের পাশ দিয়েই অন্তত তিনটে গোলের সুযোগ পেল বিপক্ষ। লিগ ম্যাচে ৪-২-৩-১ ফর্মেশন মানেই তো ড্র-এর মানসিকতা নিয়ে খেলা। আর ড্র মানেই পিছিয়ে যাওয়া। দুই প্রধান তাই পিছোল।

কলকাতা ডার্বিই যদি জেতার ইচ্ছে না থাকে তা হলে আর ভারতসেরা হওয়া যাবে কী করে?

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, অভিষেক (দীপক), রাজু, মিলান, রবার্ট, লালরিন্দিকা, মেহতাব, তুলুঙ্গা (লোবো), খাবরা (জোয়াকিম), ডুডু, র‌্যান্টি।

মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রীতম, বেলো, কিংশুক, ধনচন্দ্র, কাতসুমি (মণীশ), ডেনসন (শেহনাজ), বিক্রমজিৎ, সনি, বলবন্ত, বোয়া (লালকমল)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন