শারজায় ম্যাচ নয় কেন, প্রশ্ন আসিফের

সিবিএফএস— অর্থাৎ ক্রিকেটার্স বেনিফিট ফান্ড সিরিজ আর তাঁর নামটা এক সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আব্দুল রহমান বুখাতিরের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির শারজাকে তিনি করে তুলেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট কেন্দ্র।

Advertisement

কৌশিক দাশ

দুবাই শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:১১
Share:

ক্ষুব্ধ: শারজায় ফের ম্যাচ দেখতে চান আসিফ ইকবাল। —ফাইল চিত্র।

মরু শহরে ক্রিকেটের আরব্য রজনী লিখেছিলেন তিনি। আর এখন যখন আবার এক যুগ পরে ক্রিকেট ফিরছে সেই দেশে, তাঁকে উৎফুল্ল হওয়ার বদলে খুব হতাশ শোনাচ্ছে!

Advertisement

কেন? কী ভাবছেন আসিফ ইকবাল?

সিবিএফএস— অর্থাৎ ক্রিকেটার্স বেনিফিট ফান্ড সিরিজ আর তাঁর নামটা এক সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আব্দুল রহমান বুখাতিরের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির শারজাকে তিনি করে তুলেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট কেন্দ্র। সেই দেশেই এখন ক্রিকেট ফিরছে এশিয়া কাপের হাত ধরে।

Advertisement

তা হলে তিনি খুশি হতে পারছেন না কেন? ইংল্যান্ড থেকে ফোনে ব্যাখ্যা দিলেন আসিফ, ‘‘আমার দুঃখটা দুটো কারণে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে ক্রিকেট ফিরছে ঠিকই, কিন্তু শারজায় খেলা দেওয়া হল না কেন? মনে রাখবেন, এই শারজাই মরু শহরে ক্রিকেটের বিপ্লব ঘটিয়েছিল। পৃথিবীর প্রথম সারির ক্রিকেট খেলিয়ে সব দেশ কোনও না কোনও সময় শারজায় এসে খেলে গিয়েছে। এক সময় রেকর্ড সংখ্যক ওয়ান ডে ম্যাচ হয়েছে শারজার ওই মাঠে। তা হলে কোন কারণে এখন খেলা দেওয়া হল না?’’ একটু থেমে উত্তেজিত আসিফ বলে দিলেন, ‘‘আমি তো বলব, এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ শারজায় হওয়া উচিত ছিল।’’

কেন শারজা ভারতের কাছে ব্রাত্য সেই ২০০০ সাল থেকে? বেসরকারি কারণটা সম্ভবত কারও অজানা নেই। ম্যাচ গড়াপেটা কেলেঙ্কারিতে বারবার উঠে এসেছে শারজার নাম। অভিযোগ উঠেছে, দুবাইয়ের অন্ধকার জগৎ আর ক্রিকেট জুয়াড়িদের যোগসাজসে কালো ছায়া এসে পড়েছে শারজার ক্রিকেটে। আপনি কি এ সব জানতেন না? আপনি তো শারজা ক্রিকেটের সর্বেসর্বা ছিলেন। ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?

প্রশ্নটা শুনে একটু ভাবলেন আসিফ। তার পরে পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক বলে চললেন, ‘‘আপনি তো ম্যাচ গড়াপেটার কথা বলছেন। আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দিন। কুড়ি বছরে আইসিসি বা ওদের দুর্নীতি দমন শাখা কোনও ক্রিকেটারকে ম্যাচ গড়াপেটা কাণ্ডে ধরেছে? এক জনকেও নয়। যারা শাস্তি পেয়েছে, যাদের নাম উঠেছে— সবাই কোনও না কোনও ভাবে মি়ডিয়ার মাধ্যমে সামনে এসেছে। তার পরে শাস্তি পেয়েছে। তা হলে আইসিসি কী করল?’’ কিন্তু শারজা নিয়ে কী বলবেন? আপনার কি কখনও কোনও সন্দেহ হয়েছিল? আসিফ জবাব দিলেন, ‘‘আমি দীর্ঘদিন ধরে শারজা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। কখনও, কোনও রকম ম্যাচে গড়াপেটার ইঙ্গিত পাইনি।’’

শুরুতে আপনি বলেছিলেন, ক্রিকেট মরু শহরে ফিরলেও দুটো কারণের জন্য আপনি খুশি নন। একটা তো শারজায় ম্যাচ না হওয়া। দ্বিতীয় কারণটা কী বলবেন? ইডেনে জীবনের শেষ টেস্ট খেলে যাওয়া আসিফ বলছিলেন, ‘‘নিজেদের দেশে ক্রিকেট না খেলে দুবাই, আবু ধাবিতে ভারত-পাকিস্তান খেলছে, এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। দু’দেশের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষেরা তো বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এর জন্য না ক্রিকেট বোর্ড দায়ী, না দুই দেশের মানুষ। এটাই আমাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে।’’

ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এ বার কি দু’দেশের ক্রিকেট সম্পর্কে বরফ গলতে পারে? আসিফকে খুব একটা আশাবাদী শোনাল না, ‘‘ইমরান নিঃসন্দেহে দুটো পদক্ষেপ নেবে, কিন্তু তার পর?’’ আসিফের পরের কথা শুনে মনে হল, প্রাক্তন পাক অধিনায়ক সত্যিই কষ্ট পাচ্ছেন দু’দেশের এই ক্রিকেট-শৈত্য নিয়ে। ‘‘আমি বুঝতে পারি না, কেন এই বিদ্বেষ? কেন এই শত্রুতা? সাধারণ মানুষ তো এটা চায় না। আমি অনেক ভারত-পাকিস্তানির সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই কিন্তু বন্ধুত্বের কথাই আগে বলেছে।’’ এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই তো আপনাদের নভজ্যোৎ সিংহ সিধু পাকিস্তানে ঘুরে এল ইমরানের শপথের দিন। ওর প্রতি পাকিস্তানের মানুষ যে ভালবাসা দেখিয়েছে, আর সিধু যে ভাবে ওখানকার মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছে, সেটা তো অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাই না? দু’দেশের মানুষের এই ভালবাসাটাই তো আমরা সবাই চাই।’’

শারজা এবং আসিফ ইকবাল। এই দুটো নাম তো ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল একটা সময়। এখন শারজা বললে আপনার সামনে কী ভেসে ওঠে? একটু পরে ফোনের ও প্রান্ত থেকে জবাব এল, ‘‘ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করার পাশাপাশি আমাদের কাজ ছিল দু’দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটারদের সম্মানিত করা, সাহায্য করা। ওই প্রাক্তনরা এসে আমার সঙ্গে হাত মেলাতেন, আমাকে জড়িয়ে ধরতেন। কত জনের কথা বলব? ভারতের মুস্তাক আলি, পলি উমরিগর। পাকিস্তানের কারদার, ফজল মামুদ। সেই স্মৃতি আমি ভুলতে পারিনি। পারবও না। শারজার সঙ্গে জড়িত ওগুলোই আমার সব চেয়ে প্রিয় স্মৃতি। এখনও ভেবে ভাল লাগে, বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া ওই সব ক্রিকেটারের জন্য আমরা কিছু করতে পেরেছিলাম।’’

আর ক্রিকেট বলতে কী মনে আসে? ভারত-পাকিস্তানের কোন ম্যাচটার কথা এখনও মনে রেখেছেন? ‘‘একটা খুব কম রানের ম্যাচ হয়েছিল। ভারত খুব সম্ভবত ১২০-১২৫ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে আরও কম রানে আউট করে দেয়। ইমরান এবং কপিল ওই ম্যাচে দারুণ খেলেছিল,’’ বললেন তিনি।

আর দু’দেশের সেরা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বাছতে বললে? আসিফের তালিকায় থাকছে— এক, জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছয়। দুই, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সচিন তেন্ডুলকরের সেই মরুঝড়ের সেঞ্চুরি।

এশিয়া কাপ ইংল্যান্ডে সম্প্রচারিত হবে কি না, জানেন না। অনলাইনে দেখবেন কি না, ঠিক নেই। কথা শুনে মনে হচ্ছিল, সত্তরোর্ধ্ব আসিফ যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার যদি কোনও দিন বুখাতিরের ডাক আসে— ‘চলে এসো, দু’জনে মিলে সিবিএফএসটা চালু করি’, তা হলে কী করবেন? ফিরে যাবেন আবার ক্রিকেট প্রশাসনের দুনিয়ায়?

আসিফের হাসিটা একটু যন্ত্রণাক্লিষ্ট শোনাল। ‘‘ওপরওয়ালার দয়ায় আমি অনেক কিছু পেয়েছি। দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি। এমন জায়গায় ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিয়েছি, যা কেউ কোনও দিন ভাবতে পারেনি। শারজা নিয়ে আমার অনেক সুখস্মৃতি আছে। সেই স্মৃতির ভাণ্ডারে আর কিছু জুড়তে চাই না। আমি যেমন আছি, ভাল আছি।’’

শুনে মনে হল, মরু শহরে ভারত-পাক ক্রিকেট প্রত্যাবর্তনের দিনে তিনি যেন স্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া কোনও মানুষ।

আসিফ ইকবাল সত্যিই আর কোনও দিন ব্যাটটা হাতে তুলবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন