প্রভাতী শীল।—নিজস্ব চিত্র।
মাস আষ্টেক আগে সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর থেকে অশক্ত শরীরটাকে কোনওরকমে টেনে নিয়ে বেড়ান ঘরের মধ্যে। ষাটোর্ধ্ব প্রভাতী শীলকে দেখে কে বলবে, এক সময় মাঠ কাঁপাতেন তিনি। এশিয়ান গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখা এই অ্যাথলিট এখন কার্যত ‘ঘরবন্দি’। পুরনো দিনের অনেক কথাও আর মনে করতে পারেন না তিনি।
পূর্ত দফতরের কর্মী ছিলেন প্রকাশচন্দ্র শীল। তাঁর বাড়ি ছিল বহরমপুর শহর লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকার পঞ্চাননতলায়। প্রকাশবাবুর পঞ্চম সন্তান প্রভাতী। তাঁর পড়াশোনার শুরু স্থানীয় মণীন্দ্রনগর গার্লস হাইস্কুলে। দিদি প্রতিমাও ওই স্কুলেই পড়াশোনা করতেন। প্রভাতী বলছিলেন, ‘‘স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দিদি অনেক পুরস্কার পেত। সেই সময় ওকে নিয়ে স্কুলে খুব মাতামাতি হত। তাই দেখে মনে হয়েছিল, আমিও খেলাধুলো শুরু করি। সেই শুরু।’’ বহরমপুর শহরের রামকৃষ্ণ ব্যায়াম মন্দিরে যাতায়ােতর শুরু তখন থেকেই। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পঞ্জাবের জালন্ধরে ন্যাশানাল স্কুল গেমসে অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিয়েছিলেন। তাতে তিনি প্রথম হন। পরের বছর মণিপুরে জাতীয় স্কুল গেমসেও প্রথম প্রভাতী। জাতীয় স্কুল গেমসে কৃতিত্বের জন্য ওই সময় পরপর দু’বছর মাসিক ৬০০ টাকা করে বৃত্তি পেয়েছিলেন প্রভাতী।
নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই প্রভাতী রামকৃষ্ণ ব্যায়াম মন্দিরের পাশাপাশি প্রতি রবিবার কলকাতার ক্লাবে গিয়ে জ্যাভলিন ছোড়ার অনুশীলন করতেন। জ্যাভলিন ছোড়ার পাশাপাশি ১০০ মিটার হার্ডল্স, ২০০ মিটার দৌড়, হাইজাম্প, লংজাম্প, শটপাটের ইভেন্টেও নিয়মিত যোগদান করতেন তিনি। তরুণী বয়সে কলকাতার একটি ক্লাবের হয়ে একই সঙ্গে সাতটি ইভেন্টে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন প্রভাতী।
উচ্চমাধ্যমিক (তখন ছিল একাদশ শ্রেণি) পাশ করার পর বহরমপুরের পাঠ চুকিয়ে দেন প্রভাতী। কলকাতায় ভর্তি হলেন শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজে। কলেজপড়ুয়া প্রভাতী মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে গেলেন ‘অল ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি মিট’-এ যোগ দিতে। প্রত্যাশিত ভাবে সেখানেও চ্যাম্পিয়ন তিনি। বিএ পার্ট টু-এ পড়ার সময় খেলাধুলোয় কৃতিত্বের জন্য খাদ্য সরবরাহ দফতরের সার্কেল ইন্সপেক্টরের চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গ্রহণ করেননি। স্মৃতি হাতড়ে প্রভাতী বললেন, ‘‘সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। কলকাতা টেলিফোন্স থেকে চাকরির প্রস্তাব এলে আর ফেরাতে পারিনি।’’ পার্ট-টু পরীক্ষা দেওয়া হল না তাঁর। দৌড় বন্ধ হলেও জ্যাভলিন ছোড়া চলল।
চাকরির ব্যস্ততার মধ্যেও সাইয়ের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমসে জ্যাভলিনে ভারতীয় মহিলা দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন প্রভাতী। পদক পাননি। তবে ষষ্ঠ স্থান পান। এশিয়াডে যোগদান ছাড়াও মুম্বই (তখন বোম্বাই) ভারত, চিন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান-সহ ছয় দেশকে নিয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক মিটে জ্যাভলিন এবং শটপাটে তৃতীয় হন প্রভাতী। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছরখানেক আগে। অবিবাহিত প্রভাতী এখন কলকাতার বাসিন্দা। সর্বক্ষণের সঙ্গী এক পরিচারিকা। একদা জীবনীশক্তিতে ভরপুর প্রভাতী রোগাক্রান্ত হয়ে এখন প্রায় জবুথবু। জানলার বাইরে আকাশ দেখেই তাঁর দিন কাটে। তবে মাঠের সবুজ ঘাসগুলো তাঁকে এখন টানে। কিন্তু শরীর যে সায় দেয় না!