মাঠ ও মাঠের বাইরে পস্টিগা।
ফিকরু তেফেরা বেরোচ্ছিলেন লিফট থেকে। কানে হেডফোন। মাথায় টুপি। হঠাত্ দেখা হয়ে গেল গত বারের কলকাতা টিমের সতীর্থ বলজিত্ সিংহর সঙ্গে। হাত মেলালেন। জড়িয়ে ধরলেন। মুখে সেই পরিচিত হাসি।
লাঞ্চ টেবলে গিয়ে পুরনো কোচ আন্তোনিও হাবাসের সঙ্গেও দেখা করে এলেন ফিকরু। পুরনো দলের অন্যান্য জনাকয়েক সতীর্থকেও হাই-হ্যালো করলেন।
আবার লিফটে চেপে হোটেলের ঘরে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘যদি কাল প্রথম দলে থাকি নিশ্চয়ই কলকাতাকে গোল দেওয়ার চেষ্টা করব।’’
বদলার ম্যাচের চব্বিশ ঘণ্টা আগে কোনটা আসল ফিকরু তেফেরা?
বহিরঙ্গ দেখে কে বলবে গত বার সেমিফাইনালে টিম ম্যানেজমেন্টের তাঁকে সেই হোটেলে ঢুকতে না দেওয়ার রাগ এখনও আটলেটিকো দে কলকাতার বিরুদ্ধে পুষে রেখেছেন চেন্নাইয়ানে সই করা ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকার। আবার পরক্ষণেই ফিকরুর হুঙ্কারে মনে হবে এটাই তাঁর এই মুহূর্তে আসল মানসিকতা। পুরনো টিমের সতীর্থদের গলা জড়িয়ে ধরা, হাত মেলানো শনিবার সন্ধের নব্বই মিনিটে কোথায় উড়ে যাবে কেউ জানে না!
আটলেটিকো কোচ আন্তোনিও হাবাস যখন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বসলেন, তাঁর মুখে চওড়া হাসি। দেখে মনেই হচ্ছে না টেনশনে আছেন। আবার পরের মিনিটেই গম্ভীর মুখে বলে দিচ্ছেন, ‘‘পাস্ট ইজ পাস্ট। চ্যাম্পিয়ন যে হয়েছি সেটা মাথায় রাখছি না। এটা নতুন মরসুম। আমাদের তৈরি থাকতে হবে। প্রতিটা ম্যাচে ভাল খেলতে হবে। জিততে হবে।’’ তার পরেই এক সাংবাদিকের প্রশ্নে স্প্যানিশ কোচের রসিকতা, ‘‘আপনি বলছেন গত বার আমরা প্রচুর ড্র করেছিলাম। কিন্তু তাতেও তো আমরা চ্যাম্পিয়ন!’’ দেখেশুনে গুলিয়ে যেতেই পারে কোনটা আসল হাবাস? গম্ভীর মুখেরটা, না কি রসিকতার মেজাজে থাকাটা?
হতে পারে এটা প্রথম ম্যাচ। কিন্তু আসলে আইএসএল টু-র উদ্বোধনী ম্যাচেই থাকছে দুই ভিন্ন মানসিকতার লড়াই। দুই আলাদা স্টাইলের যুদ্ধ। দুই পৃথক দর্শনের ঠোকাঠুকি। এক দিকে হাবাসের স্টাইল অনেক বেশি ফ্লুইড। পাস, পাস, পাস। হোক গিয়ে বোরিং ফুটবল! তাতে কী? বিপক্ষকে ছুটিয়ে দম বার করে দাও। ফিকরুদের কোচ মাতেরাজ্জির মানসিকতা আবার একেবারে খাঁটি ইতালীয়। অর্থাত্ বল পজেশন কম থাক কিন্তু শেষমেশ স্কোরলাইনটা যখন সবাই দেখবে তখন একটা গোল যেন আমার টিমের নামের পাশে বেশি থাকে!
প্রাক্-মরসুমের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেই স্পেন ও ইতালীয় ফুটবল দর্শনকেই বেছে নিয়েছিলেন কলকাতা আর চেন্নাইয়ের কোচ। প্রাক্ মরসুমে মাতেরাজ্জির দল বেশি সেট পিসের উপর জোর দিয়েছিল। গত বার সবথেকে বেশি গোল হজম করা দল আরও বেশি করে রক্ষণ সংগঠনের দিকে নজর দিয়েছিল। যা ইতালিয়ানরা সাধারণত করে থাকেন। সেখানে হাবাস ফুটবলারদের ফিটনেস ও বল পজেশনের উপর জোর দিয়েছিলেন মাদ্রিদে এটিকের এক মাসেরও বেশি অনুশীলনে।
শুক্রবার জয়হরলাল নেহরু স্টে়ডিয়ামের অনুশীলনে দু’দলের ক্ষেত্রে সেই সত্যটা যেন আরও বেশি প্রতিষ্ঠিত। শুরু থেকে শেষ— পাসিং ফুটবলের উপরে জোর দিয়ে গেলেন হাবাস। শুরু করলেন সবাইকে শর্ট পাস খেলিয়ে। তার পরে চলল শুটিং, সিচুয়েশন প্র্যাকটিস।
গত বারের চ্যাম্পিয়ন আটলেটিকো দলে এ বার অনেক বদল। ফিকরু, হোফ্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলারদের বদলে এসেছেন জাভি লারা, ইয়ান হিউমরা। এ বারের দল কি পারবে ফের চ্যাম্পিয়ন হতে। হাবাস বললেন, ‘‘এ বারও দলে অনেক চ্যাম্পিয়ন টিমের ফুটবলার আছে। প্রাক্-মরসুমটা সব সময় খুব জরুরি। সেটা ভাল হয়েছে। আর আমার দলে তাদেরই জায়গা হয় যাদের শৃঙ্খলা আছে।’’ শেষ কথাটা কি ফিকরুর উদ্দেশ্যে? কে জানে!
প্রাক্-মরসুমের দিকে তাকালে দেখা যাবে একটা প্রস্তুতি ম্যাচও হারেনি কলকাতা। তার উপরে আবার দলে রয়েছেন এমন মার্কি ফুটবলার যিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের এখনও আন্তর্জাতিক ফুটবলার। হেল্ডার পস্টিগা হয়তো খুব বেশি ধারাবাহিক নন। তবে তিনি জানেন গোল করার জন্য সঠিক সময় ঠিক জায়গায় থাকার কায়দাটা। কলকাতার গত বারের মার্কি লুইস গার্সিয়ার সঙ্গে তুলনা উঠে আসলে পস্টিগা এ দিন বলে দিলেন, ‘‘নতুন একটা চ্যালেঞ্জ নিতে চাইছিলাম। আইএসএল খুব জনপ্রিয় হয়েছে। আমি কলকাতাকে ফের চ্যাম্পিয়ন করতে চাই।’’
প্র্যাকটিস দেখে যা মনে হল তাতে ৪-৪-২-এ দুই স্ট্রাইকার হিউম ও পস্টিগাকে নিয়ে শুরু করবেন হাবাস। মাঝমাঠে সদ্য আসা জাভি লারার সঙ্গে গত বারের ভরসা সেই বোরহা ফার্নান্দেজ। জোসেমির চোট থাকায় হয়তো নাটো থাকবেন অর্ণবের সঙ্গে স্টপারে। ভারতীয়দের মধ্যে জুয়েল রাজাও নেই। দুই সাইড ব্যাক হয়তো রহিম নবি ও রিনো অ্যান্টো।
চেন্নাইয়ানে এ দিন আবার যেন ইলানোকে ছেড়ে মাতেরাজ্জি মেতেছেন ভারতীয় প্রতিভাদের নিয়ে। হরমনজ্যোত্ সিংহ খাবরা ইতালির কোনও দলের হয়ে খেলতে পারেন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে সেটাও বলে ফেললেন চেন্নাইয়ানের কোচ। যা শুনে খাবরা বলছেন, ‘‘কোচ আমার সম্পর্কে এই কথা বলেছেন বলে আমি আরও বেশি ভাল খেলতে মরিয়া হব।’’
ফিকরু নিজে ফিট বলে দাবি করলেও সম্ভাব্য প্রথম একাদশে অনিশ্চিত। চোটের জন্য কাল খেলতে পারছেন না ধনচন্দ্র সিংহ। দুই ব্রাজিলীয় সেন্টার ব্যাক মাইলসন আলভেজ ও এডারও ফিটনেস সমস্যায় ভুগছেন। তবে মার্কি ইলানো রয়েছেন খোশমেজাজে। হোটেলে বসে ফুটবলে সই দিলেন দেদার। ভিকট্রি চিহ্নও দেখাচ্ছিলেন।
আইএসএল-টুর মেগা উদ্বোধনের পর প্রথম ম্যাচে কে শেষমেশ ভিকট্রি চিহ্ন দেখাবেন? পস্টিগা, না ইলানো? কলকাতা, না, চেন্নাই? জানতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা তো!
দুই নায়ক, তিন মুহূর্ত। চেন্নাই যুদ্ধের আগে সারা দিন যে ভাবে পাওয়া গেল টিম কলকাতাকে। ছবি: উৎপল সরকার।