অস্ট্রেলিয়ার ফুটির স্বাদে মজেছে জঙ্গলমহল 

ফুটি খেলার চর্চা বাড়ছে ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। ফুটিতে এই দুই জেলার ছেলে-মেয়েদের দক্ষতা দেখে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা প্রশিক্ষকেরাও অবাক। লিখছেন কিংশুক গুপ্তজঙ্গলমহলের ছেলে-মেয়েরা ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সে বরাবরই পারদর্শী। এই দুই বিভাগে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে নিজেদের বার বার প্রমাণ করেছেন তাঁরা। সম্প্রতি তাঁরাই মজেছেন ফুটি খেলায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০২:৩০
Share:

প্রশিক্ষণ: ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ফুটি প্রশিক্ষকেরা। নিজস্ব চিত্র

ডাবের মত দেখতে বল নিয়ে রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছে জঙ্গলমহলে। ‘অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবল’ বা ফুটিতে দাপাচ্ছেন পার্থপ্রতিম মাহাতো, বিজিত মাহাতো, তুষার মাহাতো, তনুশ্রী দাস, মুনমুন বসু, পূজা মাহাতো, সৌরভ সিংহেরা।

Advertisement

জঙ্গলমহলের ছেলে-মেয়েরা ফুটবল ও অ্যাথলেটিক্সে বরাবরই পারদর্শী। এই দুই বিভাগে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে নিজেদের বার বার প্রমাণ করেছেন তাঁরা। সম্প্রতি তাঁরাই মজেছেন ফুটি খেলায়। এ দেশে তুলনায় কম জনপ্রিয় এই খেলায় নজর কাড়তে পারলে মিলতে পারে বিদেশে খেলার সুযোগ। ইতিমধ্যেই জঙ্গলমহলে ঘুরে গিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন ফুটি প্রশিক্ষক।

২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর টিটাগড়ে ‘ফুটি’র রাজ্য প্রতিযোগিতা হয়। সেখানে কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মালদহ ও পশ্চিম মেদিনীপুর—এই ৬টি জেলা যোগ দিয়েছিল (তখনও ঝাড়গ্রাম জেলা হয়নি)। পশ্চিম মেদিনীপুর দলের ৭ জন ছিলেন জঙ্গলমহলের যুবক। বাকি ৫ জন ঘাটালের দাসপুর এলাকার। দলটির অধিনায়ক ছিলেন মানিকপাড়ার পার্থপ্রতিম মাহাতো। তিনিই প্রতিযোগিতার সেরা হিসেবে নির্বাচিত হন। খেলার যাবতীয় নিয়ম মেনে চলার জন্য পশ্চিম মেদিনীপুরের দলটিকে ‘ফেয়ার প্লে ট্রফি’ দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হাওড়ায় শৈলেন মান্না স্টেডিয়ামে ফুটির জাতীয় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানে বাংলা দলে ছিলেন জঙ্গলমহলের পার্থপ্রতিম মাহাতো ও বিজিত মাহাতো। বাংলা দল তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ৮ জন প্রশিক্ষক এসেছিলেন। তাঁরাই পার্থপ্রতিম ও বিজিতকে বাছাই করেছিলেন। প্রতিযোগিতায় রানার্স হয়েছিল বাংলা। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ঘাটালের দাসপুরের কলমিজোড় এবং নদিয়ার কল্যাণীতে একটি ফুটি দলের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় ফুটি দলের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রস্তুতি ম্যাচ হয়েছিল। ভারতীয় দলে বাংলা থেকে চারজন খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ঝাড়গ্রামের পার্থপ্রতিম মাহাতো। ২০১৭ সালেই মেলবোর্নে আন্তর্জাতিক ফুটি প্রতিযোগিতাতেও ভারতীয় জাতীয় দলের সুযোগ পেয়েছিলেন পার্থপ্রতিম। কিন্তু সময়মতো ভিসা না পাওয়ায় তিনি যেতে পারেননি।

ফুটি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় খেলা। এর বলটিকে দেখতে অনেকটা রাগবি বলের মতো। এই খেলায় একটি দলে ২২ জন খেলোয়াড় থাকেন। তবে মাঠে নামেন ১৮ জন। বাকিরা রিজার্ভ বেঞ্চে থাকেন। খেলার মাঠের পরিধি হয় ডিম্বাকৃতি। মাঠের আয়তন হয় দৈর্ঘ্যে ১৩৫ মিটার ও প্রস্থে ১১০ মিটার অথবা দৈর্ঘ্যে ১৮৫ মিটার ও প্রস্থে ১৫৫ মিটার। মাঠের দু’দিকে ৪টি করে ৮টি গোল পোস্ট থাকে। এর মধ্যে দু’দিকে দু’টি করে চারটি গোলপোস্ট ২৪ ফুট উঁচু পোস্ট। বাকি চারটি ১৮ ফুট উঁচু হয়। পায়ে কিক করে উঁচু পোস্টে গোল দিতে পারলে ৬ পয়েন্ট। ছোট পোস্টগুলিতে কিক করে গোল করতে পারলে এক পয়েন্ট। হ্যান্ড পাস করে গোল করলে সব পোস্টেই এক পয়েন্ট করে পাওয়া যায়।

২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর ঝাড়গ্রামের মানিকপাড়ার নেতাজি ক্লাব মাঠে একটি প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল। আয়োজক ছিল ধর্মেন্দ্র স্পোর্টস্‌ অ্যাকাডেমি এবং ফুটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল (এফএবি)। সহযোগিতায় ছিল অস্ট্রেলিয়ান রুলস্‌ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (এআরএফএআই)। সেই শিবিরে অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিলেন এ. অ্যান্টনি, হ্যারিসন জোহনস ও ব্রাডলি কুপার নামে তিন জন প্রশিক্ষক। ঝাড়গ্রামে এসে তাঁরা ফুটি খেলায় দক্ষতা বৃদ্ধির নানা পরামর্শ দিয়ে যান। অস্ট্রেলীয় কোচদের উপস্থিতিতেই জঙ্গলমহলের ৩০ জন তরুণীকে নিয়ে ঝাড়গ্রাম জেলার প্রথম মহিলা ফুটি দল তৈরি হয়। তৈরি হয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলায় অনূর্ধ্ব ১৪ ফুটি দল। এ. অ্যান্টনির কথায়, ‘‘জঙ্গলমহলের ছেলে-মেয়েদের শারীরিক সক্ষমতা বেশি। তাই অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা খেলাটি রপ্ত করে নিয়েছেন।’’

ফুটি অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সম্পাদক রাকেশ ঘোষ জানান, ফুটি খেলা আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হচ্ছে। এই খেলায় ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ ১২টি জেলা ভিত্তিক দল তৈরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার তিন কোচও ঝাড়গ্রামে ফুটির চর্চা দেখে উৎসাহিত হয়েছেন। আগামী ডিসেম্বরে রাজ্য প্রতিযোগিতায় ঝাড়গ্রামের মহিলা ফুটি দলকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এখন বাংলা ছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও কেরলে ফুটির চল রয়েছে।’’

জঙ্গলমহলে ফুটি খেলা নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের অন্যতম ধর্মেন্দ্র মাহাতো। তাঁর কথায়, “ঝাড়গ্রাম জেলার স্কুল কলেজ পড়ুয়ারাও এখন ফুটিতে আগ্রহী। এই খেলায় দক্ষ হলে বিদেশে যাওয়ার হাতছানি রয়েছে। তাই খেলাটি ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে।” ধর্মেন্দ্র স্পোর্টস অ্যাকাডেমি’র সম্পাদক দেবাশিস মাহাতো জানান, ধর্মেন্দ্রবাবুকে এখন ঝাড়গ্রাম জেলার ফুটি কোচ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। অ্যাকাডেমির সদস্য পার্থপ্রতিম মাহাতো এখন জাতীয় খেলোয়াড়। এছাড়াও অ্যাকাডেমির ছেলে বিজিত মাহাতো ও তুষার মাহাতোরা বাংলার হয়ে খেলছেন। এখন মানিকপাড়ায় ধর্মেন্দ্রবাবুর তত্ত্বাবধানে ৬০ জন শিশু-কিশোর স্কুল পড়ুয়ার ফুটির প্রশিক্ষণ চলছে। পার্থপ্রতিম, বিজিতেরা ফুটি খেলাকে জঙ্গলমহল কাপের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলেছেন।

নতুন স্বপ্ন দেখছে জঙ্গলমহল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন