সাডেনডেথ

ছেলেদের বলেছিলাম সংবর্ধনার ফুলগুলো কাঁটা হয়ে যেতে পারে

এই পৃথিবী বদলে যায় খুব দ্রুত। সাফল্যের দিনে যারা তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে, ব্যর্থ হলে তোমাকে ছুড়ে ফেলতে তারা দু’বার ভাববে না। বলেছিলেন প্রাক্তন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান। সোমবার বিকেলে বারাসত স্টেডিয়ামে কলকাতা লিগ শেষ করার পর ইমরানের এই কথাগুলোই মনে পড়ছিল! এরিয়ানের সঙ্গে ড্রয়ের পর ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় আমার টিমের উদ্দেশে ভেসে আসছিল একের পর এক টিপ্পনী।

Advertisement

সঞ্জয় সেন

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৪:৫৫
Share:

এই পৃথিবী বদলে যায় খুব দ্রুত। সাফল্যের দিনে যারা তোমাকে মাথায় নিয়ে নাচবে, ব্যর্থ হলে তোমাকে ছুড়ে ফেলতে তারা দু’বার ভাববে না।
বলেছিলেন প্রাক্তন পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান।
সোমবার বিকেলে বারাসত স্টেডিয়ামে কলকাতা লিগ শেষ করার পর ইমরানের এই কথাগুলোই মনে পড়ছিল! এরিয়ানের সঙ্গে ড্রয়ের পর ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় আমার টিমের উদ্দেশে ভেসে আসছিল একের পর এক টিপ্পনী। ভিড়ের মধ্যে বেশ কয়েকটা মুখ চোখে পড়ল, যাঁরা এই ক’দিন আগেও তেরো বছর পর আমাদের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন!
তেরো বছর পর কলকাতা লিগে তৃতীয় হওয়ার জন্য প্রচুর সমর্থকের ফোন পেয়েছি গত চব্বিশ ঘণ্টায়। যেখানে সমবেদনা, হুমকি, শাসানি, হৃদয়ভঙ্গ, ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা সব আবেগ-অনুভূতিরই উপস্থিতি রয়েছে। আর এটা মানতে দ্বিধা নেই যে কলকাতা লিগে আমার মোহনবাগান ব্যর্থ। এই চরম সত্যটা মানতে আমার কোনও লজ্জা নেই।
কয়েক দিন আগেও যখন আমাদের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে সংবর্ধনার ঢল বইছিল তখন লালকমলকে মজা করে এক বার বলেছিলাম, কলকাতা লিগে ব্যর্থ হলে এই ফুলগুলোই কিন্তু কাঁটা হয়ে বিঁধবে। এখন সেটাই হচ্ছে। আর মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলে মোক্ষ তো ওই চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটাই। সেটা না পেলে সমর্থকরা যে দুষবে সেটাও স্বাভাবিক।
কলকাতা লিগটা এ বার শেষ হয়ে গেল চোখের নিমেষে। এমনিতেই দশ ম্যাচের লিগে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ খুবই কম থাকে। আমরা প্রথম দু’ম্যাচে পয়েন্ট নষ্ট করায় তাই লিগের শুরু থেকেই এ বার ব্যাকফুটে চলে গিয়েছিলাম।
এই পরিস্থিতি থেকেও কিন্তু বেরিয়ে আসা যায়। গত বার ফেডারেশন কাপ হেরে ফেরার পর ডামাডোলের মধ্যে শুরু হওয়া আই লিগে আমার ছেলেরাই মোহনবাগানকে ভারতসেরা করে সেটা দেখিয়ে দিয়েছিল। তবে সেটা এক মাসের এবং এক লেগের লিগ ছিল না। আই লিগে আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও শেষ পর্যন্ত হাসতে পেরেছিলাম কঠিন জেদ এবং আত্মবিশ্বাসের জন্য। প্লেয়ারদের কৃতিত্ব তো ছিলই, এর সঙ্গে জুড়তে হবে ক্লাব প্রেসিডেন্ট টুটু বসু-সহ অন্য কর্তাদের নাম। দু’ম্যাচ হারের পর প্রবল আর্থিক সঙ্কটে বাগান কর্তারা সে বার যেমন পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ বারও ঠিক সে ভাবেই পাশে আছেন টুটুদা-সহ বাগানের চার শীর্ষ কর্তা। আমার বন্ধু ও ফুটবল সচিব সত্যজিৎ ও অন্য কর্তারাও পাশে আছেন সব সময়। টালিগঞ্জ ম্যাচে টেকনিক্যাল ভুলে পয়েন্ট খোয়ানোর পরেও তাঁরা আমার পাশে থেকে আশ্বস্ত করেছেন বার বার। টেকনিক্যাল টিম ও আমার সাপোর্ট স্টাফও প্রাণপাত করেছে টিমের জন্য।

Advertisement

সাফাই দিচ্ছি না। তাও বলছি এ বার যখন প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম তখন আমার আই লিগ চ্যাম্পিয়ন দলের নব্বই শতাংশ ফুটবলারই ছিল না আইএসএলে চলে যাওয়ায়। আর্থিক টানাটানির জন্য ক্লাবের কিছু করারও ছিল না। গত বার কলকাতা লিগে মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন না হলেও সেই টিমে বলবন্ত, জেজে, কিংশুক, বোয়ারা ছিল। এ বার সুমন হাজরা, আজহারউদ্দিনদের নিয়ে আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলাম। প্রস্তুতি ম্যাচে ভবানীপুর এবং রেলওয়ে এফসি-র সঙ্গে ড্রয়ের পর বুঝে গিয়েছিলাম আক্রমণ ভাগে লড়াইটা দানা বাঁধছে না।

দাওয়াই হিসেবে টুম্পাই-দেবাশিসরা বলা মাত্র এনে দিয়েছিল ডুডুকে। কিন্তু আমার নাইজিরিয়ান গোলমেশিন যখন এল ঠিক তখনই সৌভিক চক্রবর্তী আর প্রীতম কোটাল চলে গেল আইএসএল এবং জাতীয় দলে। কর্তারা ফের পাশে দাঁড়িয়ে আসিফকে এনে দিলেন। কিন্তু ডার্বিতে হারের পর সব আশার জলাঞ্জলি। তবে ট্রফি না পেলেও তিনটে ছেলেকে পেয়েছি, যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ—কেন লুইস, আজহারউদ্দিন মল্লিক এবং সঞ্জয় বালমুচু। বাগান সমর্থকদের মুখে এরা হাসি ফেরাবেই একদিন।

Advertisement

অফিসে সবুজ-মেরুন সমর্থক বেশ কয়েক জন সহকর্মী জানতে চাইছিলেন, স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে আমি কেন টিমের ফুটবলারদের নাম ধরে সমালোচনা করেছি। মিডিয়াতেও দেখলাম এটা নিয়ে বেশ হইচই। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু ছেলেদের সমালোচনা করেছি লিগ শেষ হওয়ার পরে। ছেলেরা যদি ম্যাচ বার করতে না পারে তা হলে মেকি প্রশংসা করা কোনও দিনই আমার ধাতে নেই। বরং মনে হয়, এই সমালোচনা ওদের অনেক বেশি মোটিভেট করবে।

এ প্রসঙ্গে আমার ফুটবলার জীবনের একটা ঘটনার কথা বলি। সেটা চুরাশি সাল। কোমরের চোটে ফর্মে ছিলাম না। আমাদের রেলের কোচ প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) সেটা না জেনেই আমাকে বলেছিলেন, ‘‘কী প্লেয়ার এ সব...। খালি চোট পায়।’’ কথাগুলো আমাকে মোটিভেট করেছিল। পাঁচ বছর পরে সেই প্রদীপদার কোচিংয়েই আন্তঃরেল ফুটবলে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। অধিনায়ক ছিলাম আমি।

আমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী। আমার স্বল্প বুদ্ধিতে একটা কথা বিশ্বাস করি, ঈশ্বরের নিশ্চয়ই একটা পরিকল্পনা রয়েছে মোহনবাগান টিমের জন্য। সর্বশক্তিমান সাফল্য দেওয়ার আগে ব্যর্থতার রাস্তা দিয়েও ঘুরিয়ে আনেন। কাউকেই তিনি সহজ ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দেননি। দিয়েছেন কেবল নির্দিষ্ট গন্তব্য।

আমাদের সেই গন্তব্য পরের টুর্নামেন্ট আই লিগ আর এএফসি কাপ। জানি না, এর মাঝে আর কোনও টুর্নামেন্ট খেলতে হবে কি না। তবে আই লিগে সনি-সহ পুরো টিমই পাব। আশা করি, সবুজ-মেরুন সমর্থকদের করুণ মুখগুলি তখন আর দেখতে হবে না।

আর কে না জানে, প্রকৃতির নিয়মে রাত সব থেকে অন্ধকার হয় ভোর হওয়ার আগেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন