—ফাইল চিত্র।
মুশফিকুর রহিম, শাকিব আল হাসান। কমনওয়েলথ গেমসে দেশের প্রথম সোনাজয়ী আসিফ হোসেন খান। বা অনূর্ধ্ব ১৭ দলের খুদে কিশোরীরা, যাঁরা ভারতের মাঠ থেকে সুব্রত কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেন। এঁদের সকলের মধ্যে একটা মিল আছে। সকলের উত্থানের পিছনে রয়েছে সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিকেএসপি। যে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের খেলাধুলোর ছবিটাই বদলে দিচ্ছে।
১২১ একর জমি নিয়ে তৈরি হয়েছে রাজধানী ঢাকায় প্রধান কেন্দ্র, ‘সেন্টার অফ এক্সেলেন্স’। এ ছাড়া দেশের পাঁচ জায়গায় রয়েছে পাঁচটি আঞ্চলিক কেন্দ্র। ছেলে, মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট-সহ ১৭টি খেলায় আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। আর রয়েছে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ অর্থাৎ প্রতিভা অন্বেষণ প্রকল্প।
সে ব্যবস্থাই যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা বলছিলেন অনূর্ধ্ব ১৭ দলের কোচ জয়া চাকমা। শুধু অনূর্ধ্ব ১৭-তেই নয়, জয়ার দেওয়া তালিকায় অনুযায়ী, সাফল্যের তালিকাটা আরও লম্বা। অনূর্ধ্ব ১৬ এএফসি প্রতিযোগিতায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের পর্বে যোগ্যতা অর্জন। অনূর্ধ্ব ১৮ সাফ চ্যাম্পিয়ন। পরপর তিন বার অনূর্ধ্ব ১৪ এএফসি প্রতিযোগিতায় সেরা।
কী ভাবে আসছে এই সাফল্য? কলকাতা ছাড়ার আগে বিকেএসপি অনূর্ধ্ব ১৭ দলের কোচ তুলে ধরলেন তাঁদের সাফল্যের রসায়ন। যে রসায়নের দুই প্রধান উপাদান হল, প্রতিভা অন্বেষণ এবং আবাসিক শিবির।
এ পার বাংলায় যখন জেলা স্তরে মেয়েদের কোনও ফুটবল লিগ চালু হয়নি, যখন ময়দানে স্থানীয় লিগ ম্যাচে থাকে না কোনও স্পটার বা নির্বাচক, তখন জয়া বলছিলেন, কতটা অমানুষিক পরিশ্রম করে তাঁদের কোচেরা জেলা-জেলা ঘুরে ফুটবলার বেছে নেন। ‘‘৬৪টি জেলা থেকে ফুটবলার বাছা হয়। মার্চ মাস থেকে কোচেরা গ্রুপ করে প্রত্যেকটা জেলায় চলে যান। সেখানে এক দফা পরীক্ষা দিতে হয় ফুটবলারদের। একের পর এক ট্রায়ালের মাধ্যমে বছরের শেষে এসে বেছে নেওয়া হয় বারো জন প্রতিভাকে,’’ মেয়ে ফুটবলার বাছার পদ্ধতিটা বলছিলেন জয়া।
এই ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজটা কিন্তু কয়েক দিনে শেষ হয়ে যায় না। চার থেকে পাঁচ মাস লাগে গোটা প্রক্রিয়া শেষ হতে। ১৪ বছরের কম বয়সিদেরও বেছে নেওয়া হয়। ৭০ জনেরও বেশি কোচ আছে বিকেএসপি-র। যাঁরা মার্চ মাসে প্রতিটা জেলায় চলে যান। সেখান থেকে সপ্তাহখানেকের শেষে কয়েকশো ফুটবলারকে বেছে নেওয়া হয়। যে ফুটবলারদের পরে দু’মাসের জন্য নিয়ে আসা হয় বিকেএসপি-র প্রধান কেন্দ্রে। সেখানে চলে আর এক দফা ঝাড়াই-বাছাই পর্ব। এর পরে শেষ পর্ব হয় মাসখানেকের। ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ প্রকল্প থেকে যাঁদের বাছা হয়, তাঁদের সঙ্গে ডেকে নেওয়া হয় সরাসরি ভর্তির জন্য আবেদনকারীদের। এদের মধ্যে থেকে প্রতি বছর বেছে নেওয়া হয় মোটামুটি ১২ জন ফুটবলারকে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যতম কোচ মহম্মদ শইদুল ইসলাম লিটন বলছিলেন, ‘‘এটা যে-হেতু সরকারি প্রকল্প, তাই আসন সংখ্যা বেঁধে দেওয়া আছে। তবে যখন কেউ কেউ বেরিয়ে যায়, সেই জায়গায় আমরা খেলোয়াড়দের নিতে পারি।’’
প্রশিক্ষণের পাশাপাশি খুদে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনোর ব্যবস্থাও এখানে থাকে। এমনকি, যাঁরা দু’মাসের বাছাই পর্বে যোগ দিতে আসেন, তাঁদেরও পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। বিকেএসপি-র সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত জয়া বলছিলেন, ‘‘আমরা কখনওই চাই না, বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি হোক। সে কারণে ট্রেনিং পর্ব শেষ হয়ে গেলে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে আটটা, এই সময়টায় প্রেপ স্কুলের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি যারা এখানে সুযোগ পায়, তাদের জন্যও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।’’
তিরিশ বছরেরও বেশি হয়ে গিয়েছে বিকেএসপি-র। বাংলাদেশ সরকার যে শুধু এই প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছে তা নয়, পাশাপাশি পুরস্কৃত করছে বিজয়ীদেরও। জয়া বলছিলেন, ‘‘অনূর্ধ্ব ১৬ এএফসি বিভাগের যোগ্যতা অর্জন পর্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক ফুটবলারকে ১০ লাখ করে টাকা দিয়েছেন। এটা মেয়ে ফুটবলারদের কাছে বিশাল প্রাপ্তি।’’
তিরিশ বছর ধরে বিনিয়োগের ফুল এখন ফুটছে ও-পার বাংলায়। এ-পার বাংলাতেও যার সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।