চে পূজারা: টি-টোয়েন্টি যুগের এক টেস্ট বিপ্লবী

আইপিএল এবং টি-টোয়েন্টির এই রক অ্যান্ড রোল ক্রিকেটের যুগে আপনি আলো ঝলমলে মণ্ডপ থেকে অনেক দূরে নিক্ষিপ্ত এক ক্রিকেটার। কখনও কোনও বিজ্ঞাপনে আপনার মুখ দেখা যাবে? তা হলে আর রোল মডেল হবেন কী করে?

Advertisement

সুমিত ঘোষ

সিডনি শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:১১
Share:

উচ্ছ্বাস: স্টার্কদের আগুনে বোলিং সামলে দুরন্ত সেঞ্চুরির পরে চেতেশ্বর পূজারা। বৃহস্পতিবার সিডনিতে। এএফপি

চেতেশ্বর পূজারা, আপনি যতই রান করুন, যতই সারা দিন ধরে ব্যাট করে যান, কখনও আদর্শ হতে পারবেন না!

Advertisement

আইপিএল এবং টি-টোয়েন্টির এই রক অ্যান্ড রোল ক্রিকেটের যুগে আপনি আলো ঝলমলে মণ্ডপ থেকে অনেক দূরে নিক্ষিপ্ত এক ক্রিকেটার। কখনও কোনও বিজ্ঞাপনে আপনার মুখ দেখা যাবে? তা হলে আর রোল মডেল হবেন কী করে?

এই যুগে কোন খুদে ক্রিকেটারের মুখে শোনা যাবে, আমি চেতেশ্বর পূজারা হতে চাই? কেউ বলবে, চেতেশ্বর পূজারার মতো মাটিতে বল রেখে ফ্লিক মারতে চাই? কানের দুল আর ট্যাটু বিসর্জন দিয়ে কেউ আপনার মতো শরীরকে সাজাতে চাইবে শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা, সংকল্প আর অধ্যবসায়ের উল্কি দিয়ে? চেতেশ্বর পূজারা, আপনি কখনও আদর্শ হতে পারবেন না!

Advertisement

আরও পড়ুন: বডিলাইনের ঝাপ্টা সামলে ইতিহাস সৃষ্টির মঞ্চ গড়া শুরু

কে দেখতে আসবে আপনার ব্যাটিং বলুন তো? কে মনে রাখবে আপনি কত বল খেলেছেন? চলতি সিরিজেই যেমন। অস্ট্রেলীয় বোলারদের এক হাজারের উপর বল একা ‘পাংচার’ করে দিয়েছেন। এই শব্দটাই ব্যবহার করা ঠিক, কারণ বলগুলো আপনার ব্যাটে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। তা সে আগুন ঝরানো বাউন্সার হোক বা বিষ মাখানো স্পিন।

আরও পড়ুন: ক্লান্ত হয়ে পড়বে বোলিং মেশিনও

কোনও সন্দেহ নেই, দারুণ টিমম্যান আপনি। রাহুল দ্রাবিড় যেমন ছিলেন। দ্রাবিড়-সভ্যতা বিদায় নিয়েও যেন নেয়নি। আপনার হাত ধরে যেন বংশের প্রদীপ জ্বলছে। সেই তিন নম্বর। সেই দুর্যোগের মধ্যে থেকে নীরব যোদ্ধার বর্ম পরে বারবার দলকে উদ্ধার করা। সেই পরিশ্রমীর পৃথিবী। সিডনির সময় সকাল সাড়ে দশটায় ম্যাচ শুরু, আপনি নেমে পড়লেন দশটা চল্লিশেই। কে এল রাহুল স্লিপে ক্যাচ প্র্যাক্টিস দিয়ে বিদায় নেওয়ার পরে। মাঠ থেকে বেরোলেন যখন, ঘড়িতে সন্ধে ছ’টা। মাঝে খেলা হয়ে গিয়েছে আড়াইশো বল। চলতি সিরিজে তৃতীয় সেঞ্চুরি করে ফেলেও ক্লান্ত নন। ১৩০ অপরাজিত। আজ, শুক্রবার আবার একই রকম খিদে নিয়ে নিশ্চয়ই ফিরবেন সিডনির বাইশ গজে।

স্বাধীনতার বছর থেকে অস্ট্রেলিয়া সফর করে আজ পর্যন্ত এখান থেকে সিরিজ জিতে ফিরতে পারেনি কোনও ভারতীয় দল। মনে হচ্ছে, আপনি ইতিহাসের মঞ্চ তৈরি করে দিলেন। কিন্তু আইপিএলের নিলাম টেবলে তা বলে ‘সোল্ড’ হওয়ার আশা করবেন না। সেখানে আপনার জন্য ‘নো এন্ট্রি’। এই ইনিংসের স্ট্রাইক রেট ৫২, মেরেছেন ১৬টি বাউন্ডারি। কোনও ওভার বাউন্ডারি নেই। তা হলে আর আইপিএলের স্পটাররা উৎসাহিত হবেন কী করে? চেতেশ্বর পূজারা, আপনি কী করে রোল মডেল হবেন?

অস্ট্রেলিয়ার এই বোলিং আক্রমণকে এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম সেরা বলা হচ্ছে। মিচেল স্টার্ক এবং প্যাট কামিন্স গতি এবং বাউন্সে দুর্ধর্ষ। জশ হেজ্‌লউডের হাতে রয়েছে ভাল সুইং। নেথান লায়ন বিশ্বের অন্যতম সেরা অফস্পিনার। রাহুল আউট হওয়ার পরে তিন জনের সঙ্গে আপনি ব্যাট করলেন। আপনি লায়নের বিরুদ্ধে স্টেপ আউট করছিলেন, মায়াঙ্ক আগরওয়ালও করছিলেন। মায়াঙ্ক দু’টো ছক্কা মেরে দিলেন, আপনার শটগুলো ফিল্ডারের হাতে যাচ্ছিল। কোহালি এসে প্রথম যে কভার ড্রাইভটা মারলেন, সে রকম শটই বা আপনার অস্ত্রসম্ভারে কোথায়? কভার ড্রাইভটা দেখে কমেন্ট্রিতে শেন ওয়ার্ন বাকরুদ্ধ হয়ে যান। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার আনন্দে শুধু অস্ফুটে তাঁর মুখ থেকে বেরোল, ‘‘আঃ!’’ মনে হচ্ছিল সিডনির ক্রিকেট মাঠে ভারতীয় ব্যালে শুরু হল!

দিনের শেষে তবু বাকিরা ফিরে গিয়েছেন, আপনি অপ্রতিরোধ্য। কাউকে কাউকে বলতে শুনলাম, মায়াঙ্কের যদি পূজারার মতো ধৈর্য আর শৃঙ্খলা থাকত! জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা ফেলে আসতে হত না। অন্য দিক থেকে উইকেট পড়তে থাকল, আপনি সেই অবিচল। অর্জুনের মতো লক্ষ্যে স্থির। পাখির চোখ দেখছেন। দলকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে হবে। ভারতীয় ব্যাটিংকে যখন হাইস্পিড ফেরারি গাড়ি মনে হতে থাকে আর আশঙ্কা তৈরি হয় কোথাও গিয়ে ধাক্কা না মারে, তখন আপনি এসে স্টিয়ারিং ধরেন। তখন আপনার ব্যাটিং দেখে মনে হয়, প্রত্যেকটা সিগন্যাল মেনে, সংযত ভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন। যাতে গাড়ির মধ্যে বসে থাকা গোটা দলকে দুর্ঘটনার কবলে না পড়তে হয়। এত সতর্ক গতিপথ হলে চেতেশ্বর পূজারা, আপনি কী ভাবে রোল মডেল হবেন?

শোনা যায়, ক্রিজে গিয়ে সাধকের ভূমিকায় বসে পড়ার পিছনে আপনার মায়ের হাত। ছোটবেলায় ছেলে খুব ভিডিয়ো গেমস খেলছে দেখে রিনা পূজারা শর্ত দেন, গেমস খেলতে হলে রোজ আধ ঘণ্টা ধরে পুজো করতে হবে। সেই যে শুরু হয়েছিল পুজো-প্রার্থনার রোজকার অভ্যেস, তা এখনও চলছে। ব্যাট হাতে বাইশ গজে গিয়ে ধ্যান করাটাও সম্ভবত এখান থেকেই এসেছে। আর পূজারার পুজোয় ধন্য হয় তাঁর দল।

ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে রিনা পূজারা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন অনেক দিন হল। তাঁর শিক্ষাটা কিন্তু ছেলের মধ্যে থেকেই গিয়েছে। সৎ থাকো, সাহসী থাকো, জীবনে শৃঙ্খলা হারিও না, প্রতিজ্ঞা রাখো। এগুলোই তো দেখা যায় আপনার ব্যাটিংয়ে। তা হোক, মনে রাখবেন সিডনিতেই কিন্তু শেষ। টেস্ট সিরিজ মিটে গেলেই আপনাকে লোটাকম্বল-সহ বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তখন আইপিএলের নব্য তারকাদের নিয়ে আমরা মেতে উঠব। তা হলে চেতেশ্বর পূজারা, আপনি কী করে রোল মডেল হবেন?

মায়ের মৃত্যুর পরে বাবা-মায়ের দ্বৈত ভূমিকা পালন করেছেন অরবিন্দ পূজারা। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে আপনাকে স্কুলে পাঠিয়ে অফিস চলে যেতেন বাবা। দুপুরে ফিরে ছেলেকে নিয়ে চলে যেতেন পাশের কোচিং সেন্টারে। বল ছুড়ে ছুড়ে প্র্যাক্টিস দিয়ে গিয়েছেন। আপনার বাবাই আপনার সব চেয়ে বড় কোচ। ছোটবেলা থেকেই ব্যাট আপনার সঙ্গী। তিন বছর বয়সে প্রথম প্লাস্টিকের ব্যাট হাতে পেয়ে নাকি সেটা নিয়ে ঘুমোতে যেতেন। কী আশ্চর্য— অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহলও এ দিন একই কথা বলছে— লোকটা তো দেখছি ব্যাট নিয়ে ঘুমোতেও যায়! আপনাকে নিয়ে সকলের একটাই শিরোনাম— ব্যাট, ব্যাট অ্যান্ড ব্যাট!

কে ভুলতে পারবে আপনার এবং অরবিন্দ পূজারার সেই সংগ্রামের দিনগুলো! কারসন ঘাউড়ির সাহায্যে মুম্বইয়ের ক্লাব ক্রিকেট খেলাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা। উদ্দেশ্য, মুম্বই ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচে ছেলেকে তৈরি করা। যাতে বড় হয়ে কামিন্স-স্টার্কদের এই আগুন সামলাতে পারে সে। তার জন্য ঘুপচি ঘর ভাড়া করে মাটিতে শুয়েও দিন কাটিয়েছেন পিতা-পুত্র। সেই সংগ্রামের পুরস্কার মিলল সিডনিতে।

অস্ট্রেলীয় পেসাররা বারবার শর্ট বলে সমস্যায় ফেলছিলেন। মায়াঙ্ক আগরওয়াল এবং আপনি দু’জনেই অনেক বার শরীরে আঘাত নিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল বক্সিংয়ের পাঞ্চিং ব্যাগ। যতই মারো না কেন, আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে। তার উপর সিডনির বাইশ গজে প্রথম দিনেই অসমান বাউন্স। একটা বাউন্সার থেকে মাথা নিচু করতে গিয়ে ঘাড়ের নীচে এমন লাগল যে, অনেকে শিউরে উঠলেন! এটা তো সেই ফিল হিউজ ট্র্যাজেডির ঘাতক বল! ঠিক ওই জায়গাতেই লাগল। ড্রেসিংরুম থেকে ফিজিয়ো দৌড়ে এলেন, শুশ্রূষা চলল, আপনি ঘাড়টা দু’বার এদিক-ওদিক করে আবার হেলমেট পরে দাঁড়িয়ে পড়লেন ব্যাট করতে। সংযত হয়েও কী অসম সাহসী! মনে হচ্ছিল, এক নির্ভীক যোদ্ধা শিরস্ত্রাণ পরে যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছেন।

চেতেশ্বর পূজারা, না-ই বা উচ্চারিত হলেন টি-টোয়েন্টির নিলাম টেবলে। না-ই বা জীবনে থাকল ওয়ান ডে ক্রিকেটের রঙিন মঞ্চ। যত দিন টেস্ট ক্রিকেট থাকবে, তত দিন আপনি থাকবেন। কুড়ি ওভারের স্রোতে ভেসে না গিয়ে টেস্ট ক্রিকেটের পতাকাবাহী বিপ্লবী আপনি। চে গেভারার অনুকরণে বলা শুরু হয়ে গিয়েছে চে পূজারা!

‘জ্যাক অফ অল ট্রেডস’-দের ভিড়ে যদি কেউ হতে চায় ‘মাস্টার অফ ওয়ান’, যদি কেউ স্বপ্ন দেখে টেস্ট ক্রিকেট নামক অভিযানে বেরিয়ে সর্বোচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা করব দেশের পতাকা, তা হলে চেতেশ্বর পূজারা, আপনিই সেরা উদাহরণ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন