অস্বস্তি: হুক মারতে গিয়ে পুরনো কোমরের চোটে যন্ত্রণাকাতর বিরাট কোহালি। মাঠে ডাকতে হয় ফিজিয়োকেও। বৃহস্পতিবার মেলবোর্নে। এএফপি
রিকি পন্টিং বলছেন, চেতেশ্বর পূজারার এই মন্থর ইনিংসই ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে ভারতের জন্য। টেস্টের এখনও তিন দিন বাকি এবং অস্ট্রেলিয়া যদি প্রথম ইনিংসে ভাল ব্যাটিং করে দেয়, তা হলে পাল্টা চাপ তৈরি হতে পারে ভারতের উপরে। তখন পূজারার ৩১৯ বলে ১০৬ (স্ট্রাইক রেট মাত্রাতিরিক্ত ভাবে কম, মাত্র ৩৩.২২) নায়কের ফুল না পেয়ে খলনায়কের কাঁটায় বিদ্ধ হবে। ভারত যথেষ্ট রান হাতে নিয়ে ডিক্লেয়ার করল কি না, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন পন্টিং।
অস্ট্রেলিয়াকে ৭৭ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ৪৮টিতে জিতেছেন পন্টিং। তাঁর কথাকে গুরুত্ব না দেওয়ার সাহস কে দেখাবে? শেন ওয়ার্ন নিশ্চয়ই পন্টিংয়ের মতো খাতায়কলমে সফল নেতা নন। কখনও অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক হননি। একই সঙ্গে অনেকে মনে করেন, অস্ট্রেলিয়া কখনও তাদের সেরা অধিনায়ককে টস করার সুযোগই দিল না। তাঁর নাম শেন কিথ ওয়ার্ন। এই মেলবোর্নেরই সেন্ট কিলডা থেকে লেগস্পিন কিংবদন্তির উত্থান। ওয়ার্ন আবার মনে করছেন, কোহালি একদম ঠিক কাজ করেছেন। ‘‘খুবই সাহসী সিদ্ধান্ত এবং পাল্টা অস্ট্রেলিয়াকে চাপে রাখবে,’’ টিভিতে বললেন ওয়ার্ন।
চেতেশ্বর পূজারা— যিনি মেলবোর্নের বিতর্কিত পিচে প্রায় দু’দিন ধরে ব্যাট করে গেলেন, তিনি দাবি করছেন, অন্য কোনও পিচে এতক্ষণ ধরে ব্যাট করলে তিনি ১৪০-১৫০ করে ফেলতে পারতেন। ‘‘উইকেটের চরিত্র এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের ব্যাট করতে হয়েছে। এ রকম পিচে যে কোনও ব্যাটসম্যানকেই রান করতে গেলে অনেক বল খেলতে হবে। অন্য কোনও পিচ হলে এই সময়টা ক্রিজে থাকলে আমি হয়তো ১৪০-১৫০ করে ফেলতে পারতাম,’’ দিনের খেলা শেষে সাংবাদিকদের বলে গেলেন পূজারা। ব্যাট করার জন্য কত কঠিন এই পিচ? পূজারার জবাব, ‘‘দিনে দু’শো রান তোলাটাও কঠিন মনে হচ্ছে। সে দিক দিয়ে বলব, আমরা যথেষ্ট রান তুলেছি।’’
প্রথম ইনিংসে ৪৪৩-৭ স্কোরে ডিক্লেয়ার করে দিলেন কোহালি। রবীন্দ্র জাডেজা আউট হতেই দেখা গেল তিনি ডেকে নিচ্ছেন রোহিত শর্মাকে। শেষ কয়েক ওভার ধরে বোঝাই যাচ্ছিল, ডিক্লেয়ার করে দেওয়ার ভাবনা চলছে। রোহিত এবং ঋষভ পন্থ প্রথমে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু ক্রমশ পন্থকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য বেমানান দেখাচ্ছে। ধরবেন না মারবেন, সেই গিয়ারটাই যেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না তিনি। তার পরে জাডেজা এসেও ঠুকঠুক করছিলেন না। রোহিত আক্রমণাত্মক খেলে ১১৪ বলে ৬৩ অপরাজিত থাকলেন। কিন্তু ৪৪৩ তুলতে ভারত খেলল ১৬৯.৪ ওভার। রান রেট আড়াইয়ের সামান্য উপরে।
সচরাচর এতটা মন্থর ব্যাটিং এই টি-টোয়েন্টি প্রজন্মে দেখা যায় না। আবার গরিষ্ঠ অংশের মত হচ্ছে, মেলবোর্নের পিচের মতো মন্থর বাইশ গজও তাঁরা দেখেননি। গত বছর অ্যাশেজে এ রকমই নিষ্প্রাণ পিচে ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র হওয়ার পরে আইসিসি মেলবোর্নের পিচকে ‘পুয়োর’ রেটিং দিয়েছিল। এ বারও সেদিকেই জল গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সে রকম হলে টেস্ট কেন্দ্র হিসেবে মেলবোর্নকে নিয়েই অনিশ্চয়তার মেঘ তৈরি হয়ে যেতে পারে। কোহালির মতো আগ্রাসী ব্যাটসম্যানও এই পিচে ৮২ করতে নিয়েছেন ২০৪ বল। স্ট্রাইক রেট চল্লিশের সামান্য বেশি।
আরও পড়ুন: ও’কিফের মুখের উপর যোগ্য জবাব শাস্ত্রীর
ভারত অধিনায়ক এক বার হুক মারতে গিয়ে পুরনো সেই কোমরের চোট ফিরিয়ে আনলেন। কোমর ঘুরিয়ে হুক মেরেই কোমর ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন। খুচরো রান নিতে ছোটার পথেই হাত নেড়ে ফিজিয়োকে ডাকলেন। টানটান করে শুইয়ে দেওয়া হল তাঁকে। শুশ্রূষা চলল বেশ কিছুক্ষণ। তার পর ব্যাটিং চালিয়ে গেলেও আর এক বার দেখা গেল নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে বসে পড়েছেন। শেষ বিকেলে ফিল্ডিং করার সময়েও কয়েক বার কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। মাঝেমধ্যে যন্ত্রণাকাতর মুখচোখ। কোমরের এই চোট চলতি বছরে বেশ ভোগাচ্ছে কোহালিকে। ইংল্যান্ড সফরে লর্ডস টেস্টের সময়ে বেড়ে গিয়েছিল। যদিও পুরো সিরিজেই তিনি খেলেন এবং ভারতের সর্বোচ্চ রান স্কোরার হিসেবেও শেষ করেন। এ বারেও দলের অন্দরমহলের খবর, সামান্য অস্বস্তি থেকে গেলেও তিনি দ্বিতীয় ইনিংসে বা সিডনি টেস্ট খেলতে পারবেন না, এতটা গুরুতর কিছু এখনও পর্যন্ত শোনা যায়নি।
চতুর্থ উইকেটে কোহালি এবং পূজারা ১৭০ রান যোগ করে বড় স্কোরে নিয়ে গেলেন ভারতকে। অধিনায়কের সঙ্গে পার্টনারশিপ নিয়ে পূজারা বলে গেলেন, ‘‘বিরাটের সঙ্গে ব্যাট করা সব সময়ই খুব উপভোগ করি আমি। ওর টাইমিং দেখার মতো। এই ইনিংসে অকল্পনীয় সব স্ট্রেট ড্রাইভ মারছিল।’’
সত্যিই যথেষ্ট রান তুলে ভারত ডিক্লেয়ার করল কি না, সেই প্রশ্ন কেউ কেউ তুলছেন। ৪৪৩ কি গ্যারান্টি দিতে পারে যে, দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাট করতে হবে না? উচিত ছিল কি আরও কিছুক্ষণ প্রথম ইনিংসকে টেনে সাড়ে পাঁচশো তুলে দু’বার অস্ট্রেলিয়াকে অলআউটের চেষ্টা করা? যদি অস্ট্রেলিয়া দু’দিন ধরে ব্যাট করে দেড়শো রানের ‘লিড’ নিয়ে শেষ দিনে ভারতকে পাল্টা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়, তখন কি চাপ তৈরি হয়ে যাবে না?
ভারতীয় শিবির মনে করছে, পিচ যে-হেতু মন্থর, হাতে যথেষ্ট সময় থাকা দরকার। তা ছাড়া জাডেজা আউট হওয়ার পরে পড়েছিলেন টেলএন্ডাররা। তাই তাঁদের সঙ্গে নিয়ে রোহিতকে স্ট্রাইক নিজের কাছে রেখে রান বাড়াতে হত। তাতে আরও সময় নষ্ট হতে পারত। তার চেয়ে শেষের ২৬ মিনিট অস্ট্রেলিয়াকে বুম বুম বুমরার সামনে ফেলাটা অনেক বুদ্ধিদীপ্ত চাল হয়েছে। বুমরার বাউন্সার যে ভাবে ফের মার্কাস হ্যারিসের হেলমেটে গিয়ে আঘাত করল এবং দুই অস্ট্রেলীয় ওপেনারকেই যে রকম থরহরিকম্প দেখাল ছয় ওভার খেলতে গিয়ে, তাতে প্রতিপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে থাকবে। শুক্রবার সকালে এসে তরতাজা হাওয়ায় তিন পেসারকে খেলা মোটেও সহজ হবে না। সব চেয়ে বড় কথা, বাঁ হাতি স্পিনার হিসেবে রবীন্দ্র জাডেজা আছেন। যিনি খারাপ হতে থাকা পিচে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন। মেলবোর্নে যে পিচ খারাপ হতে শুরু করেছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোনওটা লাফাচ্ছে, কোনওটা নিচু হচ্ছে। পূজারা যে বলটায় আউট হলেন, সেটা বেশ নিচু হয়ে গেল। আবার দু’তিন বার গুডলেংথ থেকে লাফিয়ে গ্লাভসের উপর দিয়ে আঙুলে লাগল।
ক্রিকেটের সেই পুরনো মতবাদ, বাইশ গজ কেমন, তা বিচার করার জন্য দু’টো দলকেই একটা করে ইনিংস খেলতে দাও। শুক্রবার অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানদের মতোই তাই অগ্নিপরীক্ষা মেলবোর্নের!