দুই তারকার মোহনায় জীবনের দৌড় কলকাতার

দৌড় জীবনের চলার পথ। জীবনটাই দৌড়! রবিবার রেড রোডে তখন সবেমাত্র দিনের আলো উঁকি দিয়েছে। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে কথা দু’টো গমগমে সাউন্ড সিস্টেমে আশপাশের ময়দান চত্বরেও ছড়িয়ে পড়ছিল। বক্তাদ্বয়ের নাম যথাক্রমে বরিস বেকার এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

Advertisement

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৬
Share:

এসো সেলফি তুলি! কলকাতা দৌড়ের ফাঁকে।

দৌড় জীবনের চলার পথ। জীবনটাই দৌড়!

Advertisement

রবিবার রেড রোডে তখন সবেমাত্র দিনের আলো উঁকি দিয়েছে। মিনিট কয়েকের ব্যবধানে কথা দু’টো গমগমে সাউন্ড সিস্টেমে আশপাশের ময়দান চত্বরেও ছড়িয়ে পড়ছিল।

বক্তাদ্বয়ের নাম যথাক্রমে বরিস বেকার এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

Advertisement

পরের ঘণ্টা চারেক ‘কলকাতা টোয়েন্টি ফাইভ কে’ রেসের মুখচ্ছবিও তাই— দৌড়ই জীবন!

জীবনের আবেগ, রং, হতাশা, যন্ত্রণা, রসিকতা, ঔজ্বল্য— সব পরতে-পরতে মিলেমিশে একাকার যেন ছুটির দিনের শহরের দৌড়ে। কখনও টেনিস বিশ্বের প্রবাদপ্রতিম তারকা প্রচণ্ড আগ্রহী তাঁর আইপ্যাডে হাজার হাজার নারী-পুরুষের দৌড়ের রেকর্ডিং করতে। কখনও দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অধিনায়ক সঞ্চালকের হাত থেকে কর্ডলেস মাইক কেড়ে নিয়ে নিজেই বলছেন, ‘‘দৌড়োন দৌড়োন। আমাদের ছবি তুলতে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বেন না প্লিজ। রান... রান।’’ ইভেন্টের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর ও প্রধান অতিথির ছবি, সেলফি তুলতে ততক্ষণে কয়েকশো মানুষ দৌড়টৌড় থামিয়ে ভিআইপি মঞ্চের সামনে!

দেশের প্রথম সারির কুড়ি জন দৌড়পাল্লার অ্যাথলিটের সঙ্গে আট থেকে আশি না হোক, পনেরো থেকে সত্তর বছর বয়সি এগারো হাজারেরও বেশি মানুষ এ দিন দৌড়লেন কলকাতার আদি ডিসট্যান্স রান-এ। যাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন কলকাতা পুলিশের নানা ব্যক্তিত্ব, তেমন কর্পোরেট জগতের কিছু ‘হুজ হু’-ও। পেশাদারদের ২৫ কিমির পাশাপাশি অপেশাদারদের দশ, পাঁচ, দুই কিমির নানা ক্যাটেগরি। কোনওটার নাম পুলিশ কাপ। কোনওটা আনন্দ রান। যাতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ অংশ নিলেন। কে দৌড়চ্ছেন না সেখানে? কাঁধে ঝোলানো ঢাক বাজাতে বাজাতে মেদিনীপুরের ঢাকিওয়ালা। ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ সাজে এক পরী। কিংবা একটা ডোনাল্ড ডাক্! আরও আছে। নয় নয় করে আঠেরো জন রানারের হাঁটু প্রতিস্থাপন করা!

রবিবাসরীয় ইভেন্টের জন্যই শহরের নামী তবলাবাদক বিক্রম ঘোষের তৈরি থিম সং ‘রান... রান.. দৌড়ান’ সুরের মুর্ছনার ভেতর যখন তিয়াত্তর জন প্রতিবন্ধীর রেস স্টার্টিং ব্লক থেকে এগোল, বেকার-সৌরভের মতোই নাগাড়ে হাততালি দিয়ে যাচ্ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, লক্ষ্মীরতন শুক্লরা। যে রেসে হুইলচেয়ার, ক্র্যাচ থাকবে। ছিলও। কিন্তু হাঁটুর নীচ থেকে একটা পা না থাকা এক তরুণ যখন হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে রেড রোড ধরে ভোরের স্নিগ্ধ রোদে ক্র্যাচে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন— তার চেয়ে বড় জীবন-দৌড় আর কী পারত!


বাধা যেখানে হার মানে। রবিবার রেড রোডে।

মূল পঁচিশ কিলোমিটার রেসের ফ্ল্যাগ অফ করেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। যে রেসে চ্যাম্পিয়ন হলেন এই মুহূর্তে দেশের জাতীয় পাঁচ ও দশ হাজার মিটার চ্যাম্পিয়ন জি লক্ষ্মণন। তিনি (১ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ড) এবং রুপো ও ব্রোঞ্জজয়ী, তিন জনই ভাঙেন গত বারের কলকাতা রেসের রেকর্ড (১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড)। মেয়েদের মধ্যে সবার আগে ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে বেকার-ঋতুপর্ণাদের সঙ্গে হাত মেলালেন এ বছরই দিল্লি হাফ ম্যারাথনে সেরা মোনিকা আতারে। দুই চ্যাম্পিয়ন পেলেন আড়াই লাখের চেক। লক্ষ্মণন রেকর্ড ভেঙে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য বাড়তি আরও পঞ্চাশ হাজার। সৌরভ ততক্ষণে সন্ধেয় আটলেটিকো কলকাতার আইএসএল ফাইনাল দেখার জন্য কোচির উড়ান ধরতে দমদম এয়ারপোর্টে দৌড়েছেন।

তার আগেই বেকারের আগের দিনের বুম বুম সার্ভকে এ দিন সলিড রিটার্ন ভলি মেরে যান সৌরভ! ক্রিকেটে রানের মাথামুণ্ডু বোঝেন না তিনি— বেকারের এই খোঁচার জবাব কলকাতা রেসের মঞ্চ থেকে মাইকে দিলেন সৌরভ। ‘‘বরিস, ক্রিকেটটা বোঝা তো তোমার জন্য খুব সহজ। খেলাটা অনেকটা টেনিসের মতোই। ওখানে হাতে র‌্যাকেট, এখানে হাতে ব্যাট। তবে হ্যাঁ, তোমরা যে বল-এ খেলো সেটা সফ্ট। নরমসরম। আমরা যে বল-এ খেলি সেটা কিন্তু হার্ড। কোনও শট গায়ে লাগলে প্রচণ্ড চোট লাগতে পারে।’’ সর্বকালের কনিষ্ঠতম উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন সম্ভবত প্রিন্স অব কলকাতার ‘ফর্ম’ দেখে ফুটবলে ঢুকে পড়লেন। ‘‘আজ তো ওবেলা কলকাতা টিমের ফুটবল ফাইনাল। ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে। বেস্ট অব লাক সৌরভ!’’

শীতের সকালের মিঠে রোদে ততক্ষণে সৌরভ মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরেছেন বেকারকে।

ছবি: শঙ্কর নাগ দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন