নতুন ‘ওয়াল’ পূজারা কী ভাবে হলেন অলরাউন্ডার থেকে ব্যাটসম্যান

চেতেশ্বর পূজারার বেড়ে ওঠার কাহিনি কৈশোরের কোচের মুখে। মুম্বইয়ের সেই অধ্যায় এক থ্রিলার।চেতেশ্বর পূজারাকে আমি প্রথম দেখি যখন ওর বয়স দশ বা এগারো হবে। একেবারেই বাচ্চা একটা ছেলে। ওর বাবা অরবিন্দ আমার খুব ভাল বন্ধু।

Advertisement

কারসন ঘাউড়ি

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭ ০৩:৫৪
Share:

নায়ক: চলতি সিরিজে ব্যাট হাতে ভারতীয় দলের প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছেন পূজারা। রাঁচীতেও ম্যান অব দ্য ম্যাচ।

চেতেশ্বর পূজারাকে আমি প্রথম দেখি যখন ওর বয়স দশ বা এগারো হবে। একেবারেই বাচ্চা একটা ছেলে।

Advertisement

ওর বাবা অরবিন্দ আমার খুব ভাল বন্ধু। আমরা একসঙ্গে অনেক ম্যাচ খেলেছি। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে কলেজ, তার পর রাজ্য স্তরেও বিভিন্ন বয়স বিভাগে আমি আর অরবিন্দ নিয়মিত ভাবে খেলেছি। তাই খেলোয়াড় জীবন থেকেই আমরা দু’জনে খুব ভাল বন্ধু।

অরবিন্দের শখ ছিল ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবে। খুব ছোটবেলাতেই চেতেশ্বরের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ দেখতে পেয়েছিল ও। তাতেই ছেলেকে নিয়ে ভাবনাটা আরও গতি পেয়েছিল। অরবিন্দের মনে হয়েছিল, চেতেশ্বরকে সফল ক্রিকেটার করতে হলে ওকে মুম্বই নিয়ে আসতে হবে। মুম্বই মানে তখনও তো সত্যিই ক্রিকেটের স্বর্গ। আমাদের এখানকার ক্লাব ক্রিকেটের কাঠামোটাই এত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যে, সেই সংঘর্ষের পৃথিবীতে পড়ে যে-কারও মানসিকতা তৈরি হয়ে যায়। সম্ভবত সেটাই মনে এসেছিল আমার বন্ধু অরবিন্দেরও।

Advertisement

অরবিন্দ ওর ছেলেকে নিয়ে মুম্বই চলে এল। খুব কষ্ট করেই ওদের থাকতে হতো। তবু সেই কষ্টটা অরবিন্দ হাসি-মুখে করেছিল ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এখন ক্রিজে দাঁড়িয়ে চেতেশ্বরের চোয়াল শক্ত করা মুখটা দেখলে আমি তাই একটুও না ভেবে বলে দিতে পারি, এটা ওর বাবার থেকে পাওয়া। অরবিন্দ জানে কী ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয়। মুম্বইয়ে ছেলেকে নিয়ে পড়ে থাকার সময়েই সেটা দেখেছি আমি। কখনও বন্ধুর বাড়িতে থেকেছে, কখনও পরিচিত কারও ঘর হয়েছে ওদের ঠিকানা। কিন্তু বাবা-ছেলে তাদের ক্রিকেট অভিযানে কখনও আপস করেনি।

চেতেশ্বর যখন মুম্বইয়ে এল, তখন আমি ভারত পেট্রোলিয়ামের কোচ। ওখানেই ওকে নিয়ে এসেছিল আমার বন্ধু অরবিন্দ। শুরুতেই চিন্টুর (চেতেশ্বরের ডাকনাম) একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেটা হল নিজে কাঁধে করে নিজের কিটব্যাগ আনত, আবার নিজে গোছগাছ করে সেটা নিয়ে ফিরে যেত। দশ-এগারো বছর বয়সেও চেতেশ্বরকে কখনও দেখিনি বাবাকে কিটব্যাগ নিতে দিচ্ছে।

সেটা দেখে আমার দু’টো জিনিস মনে হয়েছিল। এক) ছেলেটার মধ্যে একটা জেদ আছে যে, এটা আমার পৃথিবী। আমি লড়াই চালিয়ে যাব। দুই) ক্রিকেট সরঞ্জামের প্রতি যত্ন ও সম্মান করতে জানে। হেলাফেলা করে নিয়ে যাওয়া নয়, গুছিয়ে নিজের জিনিসটা নিজে কাঁধে করে নিয়ে যাব।

যাই হোক, কিশোর চেতেশ্বর আমাদের ক্যাম্পে যখন এসেছিল, তখন ব্যাট-বল দু’টোই করত। কিন্তু অত ছোট বয়সেও ওর ব্যাটিংটাই ভীষণ ভাবে আমার নজর কেড়ে নিয়েছিল। ওই বয়সেই চেতেশ্বরের টেকনিক আর ধীর-স্থির মানসিকতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। তখনই উইকেট ছুড়ে দিতে প্রবল অনীহা। সারা দিন ধরে পরিশ্রম করে যেতে পারে মুখ বুজে। নিজে অলরাউন্ডার হলেও আমার মনে হয়েছিল চেতেশ্বরের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল অলরাউন্ডার হিসেবে নয়। ও অনেক দূর যেতে পারে ব্যাটসম্যান হিসেবে। বন্ধুকে মনের কথাটা বলেই দিলাম।

লোকে বলে অরবিন্দকে দেওয়া আমার সেই পরামর্শই নাকি চেতেশ্বরের জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয়, চেতেশ্বর পূজারা নামের উচ্ছ্বাস ভারতীয় ক্রিকেটে আছড়ে পড়তই। আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম, বিরাট ঢেউটা আসছে।

চেতেশ্বরের সাফল্যের জন্য যদি কারও কৃতিত্ব প্রাপ্য হয়, সেটা ওর বাবা, আমার বন্ধু অরবিন্দের। এমন দায়বদ্ধতা নিয়ে আমি খুব কম পিতাকে পড়ে থাকতে দেখেছি। কী না করেছে ও ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর জন্য। যখন যেখানে দরকার, অফিস ফেলে ছুটে গিয়েছে। অর্থের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, তবু নিজের কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছে। নিজে ক্রিকেট খেলত অরবিন্দ। কোচিং ক্যাম্পও চালায়। ক্রিকেট অন্ত প্রাণ। ছেলেকে নিয়ে পরিশ্রমে কখনও ত্রুটি রাখেনি।

আরও পড়ুন: পূজারা থাকা মানে একটা সেনাবাহিনী থাকা

চিন্টুর মা-কে আমি কখনও দেখিনি। মুম্বইয়ে অরবিন্দই এসেছিল ছেলেকে নিয়ে। বন্ধু ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীকে অকালে হারিয়েছিল। সেটা জানতাম। সেটা ছিল ওদের দু’জনের কাছে বিশাল আঘাত। শুনেছি, চেতেশ্বরকে ওর মা-ই শিখিয়েছিল রোজ স্নান করে উঠে ঠাকুর প্রণাম করতে হবে। ক্রিজে দাঁড়িয়ে চেতেশ্বরের মনঃসংযোগ আর ধৈর্য ধরে পড়ে থাকার মধ্যে ওর মায়ের এই ধার্মিক শিক্ষার বড় অবদান রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। রাঁচীতে চেতেশ্বর রেকর্ড ৫২৫ বল খেলল। ওর ধৈর্যশীল ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল যেন, ধ্যান করছে। বাস্তব জীবনে ঈশ্বর ভক্তির মাধ্যমে ওকে কিন্তু ধ্যান করতে হয়েছে।

রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে খুব তুলনা টানা হয় চেতেশ্বরের। আমার মনে হয়, এক দিক দিয়ে তুলনাটা ঠিক। কারণ, দ্রাবিড়ের মতোই অনাড়ম্বর, পরিশ্রমী তারকার নকশায় বড় হয়েছে চেতেশ্বর। আবার তুলনাটা এখনই করার পক্ষপাতী নই কারণ, আমি মনে করি ভারতীয় ক্রিকেটে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়। ওর সঙ্গে তুলনায় আসতে গেলে তাই চেতেশ্বরকে এখনও অনেক পথ পেরোতে হবে।

তবে ছোটবেলা থেকে চেতেশ্বরকে দেখার সুবাদে বলতে পারি, রাহুলের মতোই ওর রানের খিদে। রাহুলের মতোই শৃঙ্খলা মেনে চলা জীবন। সেই মানসিকতা। সেই টেকনিকের প্রতি ঝোঁক। রাহুলকে দেখে যেমন আমার মনে হতো এই ছেলেটা ক্রিকেটের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে ভাবেই না, চেতেশ্বরকে দেখেও সেটাই মনে হয়েছে বরাবর। মনে হয়েছে, শুধু ক্রিকেট মাঠে বলে নয়, মাঠের বাইরের ব্যক্তিগত জীবনেও দু’জনের জীবনে একটা লাগাম আছে। মাঠের বাইরেও ওরা ভাল মানুষ আর শান্ত, নির্ভেজাল ভদ্রলোক।

সময় বলবে, রাহুলের মতো ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন দেওয়াল হয়ে উঠতে পারবে কি না পূজারা। তবে শক্তপোক্ত, দৃঢ় গাঁথনি যে উঠতে শুরু করেছে সেটা তো রাঁচীতে দেখা গেল। মুম্বইয়ের সেই ক্যাম্পে দু’দিন দেখার পরেই আমার কী মনে হয়েছিল কে জানে! বন্ধু অরবিন্দকে বলে দিলাম, ওকে শুধু ব্যাট করাতে হবে। ইন্ডিয়া খেলবে তোমার ছেলে। কখনও মনে হয়নি, ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছি। স্ট্রাইক রেটের কথা তুলে যখন ওকে ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হল, তখনও পরিচিতদের বলেছি, চিন্টু ফিরে আসবেই। ওকে বাইরে রাখা যাবে না। সাধকের চোখের দ্যুতি যে দেখে নিয়েছিলাম বারো বছর বয়সেই!

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন