পরের মরসুমে আন্দ্রে ইনিয়েস্তাকে আর বার্সেলোনার জার্সি গায়ে খেলতে দেখব না লিয়োনেল মেসির পাশে। এটা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
মাঝমাঠে ইনিয়েস্তা খেলা মানেই বার্সেলোনা বা স্পেন কখন ভোজবাজির মতো ম্যাচ বার করে নেবে তা কেউ জানে না। ছোটবেলায় আমার ফুটবল-জীবনের পথপ্রদর্শক বলাইবাবু (প্রয়াত বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়) বলতেন, ফুটবলে যে কোনও দলের মেরুদণ্ড হল মাঝমাঠ। আক্রমণ গড়া এবং ভাঙার দায়িত্ব এই বিভাগের। দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মাঝমাঠের খেলোয়াড়রা।
আমার খেলোয়াড় জীবন থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ব ফুটবলে অনেক নাম করা মাঝমাঠের ফুটবলার দেখেছি। ডিডি, সক্রেটিস, পল ব্রাইটনার, মিশেল প্লাতিনি, লোথার ম্যাথিউস, পল স্কোলস, জাভি হার্নান্দেজ...। এঁদের মধ্যে আমার পছন্দের প্রথম দুইয়ে থাকবেন, ব্রাজিলের সক্রেটিস আর ফ্রান্সের প্লাতিনি। আর তিন নম্বরে ইনিয়েস্তা।
১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ী কোচ ভিসেন্তে ফিয়োলা বলতেন, ‘‘ফুটবল খেলাটা খুব সহজ। বল ধরো, এগোও, পাস দাও। তার পরে নিজে জায়গা নাও।’’ বার্সেলোনার বিখ্যাত অ্যাকাডেমি ‘লা মাসিয়া’ থেকে উঠে আসা ইনিয়েস্তা ঠিক এই ঘরানার ফুটবলার। যিনি বড় হয়ে স্পেনের জাতীয় দলে খেলার সময় খুদে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে বলেন, ‘‘ফুটবল খেলতে গিয়ে বেশি ভাবার কিছু নেই। মাঠে নেমে তোমার মূলমন্ত্র তিনটে। রিসিভ, পাস আর জায়গা নেওয়া।’’ গত এক যুগ ধরে বার্সেলোনা ও স্পেনের হয়ে ঠিক এই কাজটাই যে নিখুঁত ভাবে করে গিয়েছেন ইনিয়েস্তা। গোল করতে বা করাতে, দুই ভূমিকাতেই সফল। একই সঙ্গে জানেন ঠিকানা লেখা পাস বাড়াতে। জানেন কখন আক্রমণে যেতে হবে। কখন আবার নিচে নেমে এসে রক্ষণকে সহায়তা করতে হবে। মেসির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ইনিয়েস্তা পাশে থাকায় বার্সেলোনার আর্জেন্তিনীয় রাজপুত্র অনেক মুক্ত মনে খেলতে পেরেছেন ক্লাব ফুটবলে।
যেমন ড্রিবল করেন, তেমনই দুরন্ত পাস বাড়ান। চকিতে বল ধরে যেমন ঘুরতে পারেন, তেমনই দুর্দান্ত গতি আর প্রখর ফুটবল বোধ ইনিয়েস্তার। বিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে নিজের দলের ফুটবলারের সঙ্গে বল দেওয়া নেওয়া করে কখন যে অরক্ষিত জায়গায় পৌঁছে যাবেন কেউ বুঝতে পারবে না। মাথাটা যেন কম্পিউটার!
কত উদাহরণ দেব! ২০০৮-০৯ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। বার্সেলোনায় সে বারই পেপ গুয়ার্দিওলার প্রথম বছর। সেমিফাইনালে মেসি-ইনিয়েস্তাদের সামনে খুস হিডিঙ্কের চেলসি। প্রথম পর্বের ম্যাচ শেষ হল ০-০। ফিরতি পর্বে চেলসির ঘরের মাঠ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে শুরুতেই মাইকেল এসিয়েনের গোলে এগিয়ে হিডিঙ্কের দল। নব্বই মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে বার্সেলোনা। মুখে হাসি ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, জন টেরিদের। ইনজুরি টাইমে সেই হাসি মিলিয়ে গেল ওঁদের। চেলসি বক্সের সামনে মেসি যখন স্কোয়ার পাসটা বাড়ালেন তখন ইনিয়েস্তা যেন জানতেন বলটা তাঁর জন্যই আসছে। আর সেখান থেকেই গোল শোধ বার্সেলোনার। ‘অ্যাওয়ে গোল’-এর সুবাদে ফাইনালে বার্সেলোনা। ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালেও সেই একই রকম ব্যাপার। একদম অন্তিম মুহূর্তে নেদারল্যান্ডস রক্ষণ থেকে বলটা যখন ছিটকে ফ্যাব্রেগাসের পায়ে এল, তখনই ইনিয়েস্তা যেন বুঝে গিয়েছিলেন বলটা ওঁর কাছেই আসছে। সেখান থেকে ইনিয়েস্তার সেই ঐতিহাসিক গোল। বাকিটা স্পেনের ফুটবল ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এই ২০১৮ সালেও ইনিয়েস্তার সেই কম্পিউটারের মতো মগজের প্রয়োগ দেখলাম চ্যাম্পিয়ন্স লিগে। আবার সেই চেলসির বিরুদ্ধে। ম্যাচের আগে প্রচুর আলোচনা হচ্ছিল চেলসির বিরুদ্ধে মেসির তখনও পর্যন্ত কোনও গোল না পাওয়া নিয়ে। কিন্তু সেই ‘মিথ’ ভেঙে গেল ইনিয়েস্তার একটা ঠিকানা লেখা পাসে। যেন জানতেন বলটা বাড়ালে তা ঠিক মেসির পায়েই যাবে।
বার্সেলোনার হয়ে শেষ কোপা দেল রে ফাইনালে সেভিয়ার বিরুদ্ধে মেসিদের ৫-০ জয়ের ম্যাচে একটা গোল করেছেন ইনিয়েস্তা। তার পরে ভক্তদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে অশ্রুসজল চোখে মাঠ ছেড়েছেন। যা দেখে ১৯৬৮ সালে মোহনবাগান জার্সি গায়ে স্পোর্টিং ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জীবনের শেষ ম্যাচে আমার গোল করে মাঠ ছাড়ার মুহূর্তগুলো মনে পড়ছিল। ইনিয়েস্তা এ বার খেলবেন এশিয়ায়। ওঁর ভক্তরা বলছেন, ‘যেও না ইনিয়েস্তা। আরও কয়েক দিন খেলে যাও বার্সেলোনার হয়ে।’
নিজে একটু-আধটু ফুটবল খেলেছি বলেই জানি, এটা একজন ফুটবলারের কাছে কত বড় সম্মান। গত কয়েক বছর ধরেই হাঁটুর চোট ওঁকে ভোগাচ্ছিল। তাই ঠিক সময় ইউরোপ ছেড়ে এশিয়ায় খেলতে আসছেন ইনিয়েস্তা। সময়জ্ঞানটাও ওঁর ঠিকানা লেখা পাসের মতোই নিখুঁত।