Sports News

দাদা দাদা - কুল কুল

এই মিলের বাজারেও দু’জনের খেলার স্টাইল এবং অ্যাটিটিউডে কিন্তু ফারাকটা বিস্তর। একজন বাঁ হাতি তো একজন ডান হাতি। একজন ব্যাটিং ছাড়াও বল হাতে নেমেছেন, অন্যজনের স্থান সব সময়ই ছিল উইকেটের পিছনে। আর সব থেকে বড় পার্থক্য চরিত্রে। এক জন ভীষণ রকমের আগ্রাসী। অন্য জন, ঠিক তার বিপরীত। এক্কেবারে শান্ত!

Advertisement

সুচরিতা সেন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৭ ০০:১৬
Share:

এক ফ্রেমে ভারতের দুই সেরা অধিনায়ক। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ও এমএস ধোনি। —ফাইল চিত্র।

গায়ে লাগানো পর পর দু’দিন, দুটো জন্মদিন। জুলাইয়ের সাত এবং আট। তার ঠিক আগেই দু’জনের প্রোফাইলে চোখ বোলাতে গিয়ে দু’টি সংখ্যাতে আটকে গেলাম। ‘পাঁচ-এগারো’। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্র সিংহ ধোনির উচ্চতা।

Advertisement

দু’জনের মধ্যে মিল থাকে। তাই বলে এতটা! হোঁচটটা তাই খেতেই হল। শুধু এই দু’টি নয়, সৌরভ-ধোনি জুটির আরও দুই মিল রয়েছে। দু’জনেই নিজেদের রাজ্যে প্রথম ক্রিকেটার, যাঁরা ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্থায়ী অধিনায়ক হয়েছেন। আর সবচেয়ে মজার, মহারাজ-মহেন্দ্র দু’জনেরই একটি করে কন্যা সন্তান।

আরও খবর: কাসপারভকে আবার দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছি

Advertisement

এ তো গেল মাঠের বাইরের মিল। মাঠের ভিতরের হিসেবেও কিন্তু মিল রয়েছে। সাফল্যের মিল। সেই নিরিখে দু’জনেই কিন্তু ডিস্টিংশন পেয়ে পাশ করেছেন।

তবে, এই মিলের বাজারেও দু’জনের খেলার স্টাইল এবং অ্যাটিটিউডে কিন্তু ফারাকটা বিস্তর। একজন বাঁ হাতি তো একজন ডান হাতি। একজন ব্যাটিং ছাড়াও বল হাতে নেমেছেন, অন্যজনের স্থান প্রায় সব সময়ই ছিল উইকেটের পিছনে। আর সব থেকে বড় পার্থক্য চরিত্রে। এক জন ভীষণ রকমের আগ্রাসী। অন্য জন, ঠিক তার বিপরীত। এক্কেবারে শান্ত!

২০০২-এর ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনালের সেই ছবিটা মনে আছে? লর্ডসের মাঠে ভারত-ইংল্যান্ড ম্যাচ চলছে। ভারতকে জিততে হলে শেষ ওভারে ২ রান করতে হবে। হাতে মাত্র দুই উইকেট। ক্রিজে জাহির খান এবং মহম্মদ কাইফ। গোটা মাঠের মতো ড্রেসিংরুমের মুখও থমথমে। বাকি টিম মেম্বারদের সঙ্গে অধিনায়ক সৌরভ লর্ডসের ব্যালকনিতে বসে। রেলিঙে তোলা পা, বোতাম খোলা টি-শার্টের ভিতর একটা হাত সেঁধিয়ে রয়েছেন। চোখেমুখে উত্তেজনা স্পষ্ট। ওভার শেষ হওয়ার আগে ওই দু’রান নিয়ে ৩২৬ করে জিতে যায় ভারত। শেষ রানটা নেওয়ার পরেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পড়েন সৌরভ। বাকিরা যখন লাফাচ্ছেন, তিনি তত ক্ষণে খুলে ফেলেছেন নীল টি-শার্ট। খালি গায়ের অধিনায়ক ডান হাতে সেটা বাঁই বাঁই করে উড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দিচ্ছেন ফ্লিনটফকে। তার কয়েক দিন আগেই তো মুম্বইয়ের মাঠে একই কায়দায় জামা খুলেছিলেন ইংল্যান্ডের ওই অলরাউন্ডার।

হ্যাঁ, এটাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দাদা’।

এক সঙ্গে খেলার দিনগুলি।

এই ম্যাচের থেকে ধারে এবং ভারে অনেক-অনেক মাইল এগিয়ে ছিল ২০১১-র বিশ্বকাপ। ফাইনালে মুম্বইয়ে ভারতের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কা। এখানেও শেষে ব্যাট করছিল ভারত। টার্গেট ২৭৪ নিয়ে ক্রিজে তখন যুবরাজ সিংহের সঙ্গে খোদ অধিনায়ক ধোনি। অবিশ্বাস্য একটা ইনিংস খেলেছিলেন এমএস। ৭৯ বলে ৯১ নট আউট। তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছিল উইনিং শট, বিশাল একটি ছয়। কিন্তু, বিশ্বকাপ জেতার সেই মুহূর্তে ধোনি ছিলেন একেবারে নীরব, শান্ত। উচ্ছ্বাসে যখন ফেটে পড়েছিল গোটা দেশ, তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তখন কোথাও উত্তেজনার লেশ মাত্র ছিল না! এত বছর পরে দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে কোনও অধিনায়ক এতটা শান্ত থাকতে পারেন কী করে?

হ্যাঁ, এটাই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ক্যাপ্টেন কুল’।

দু’জনে দুটো ভিন্ন সময়ে দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেট যখন গড়াপেটার অভিযোগে বেসামাল, ঠিক সেই সময়ে টিমকে তুলে দেওয়া হয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামক এক তরুণ তুর্কির হাতে। দল নয়, তখন মাঠে নেমে যেন খেলত ১১ জন ‘ইন্ডিভিজুয়াল’ খেলোয়াড়। কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বড় রান বা বেশি উইকেট নিলে তবেই সাফল্য আসত। নচেত্ নয়। সৌরভকে দায়িত্বের পাশাপাশি দেওয়া হয়েছিল আনকোরা একঝাঁক মুখ। হরভজন সিংহ, যুবরাজ সিংহ, অজিত আগরকর, জাহির খান, বীরেন্দ্র সহবাগ, আশিস নেহরা— সঙ্গে সচিন তেন্ডুলকর এবং রাহুল দ্রাবিড়। যাঁরা প্রতিবাদের ভাষাটাই তেমন করে জানতেন না। ভারতীয় দলকে ‘কথা’ বলতে শিখিয়েছিলেন সৌরভ। শিখিয়েছিলেন চোখে চোখ রেখে কী ভাবে পাল্টা দিতে হয় টিম অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তানকে। সৌরভের হাত ধরেই ১১ জন ক্রিকেটার আসলে ‘টিম ইন্ডিয়া’ হয়ে উঠেছিল। গড়াপেটার ছায়া থেকে বেরিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে আবার লড়াইয়ে ফিরেছিল ভারতীয় ক্রিকেট। ২০০০ থেকে ২০০৫। সৌরভের হাত ধরে বিদেশের মাটিতে টেস্ট জয়, অস্ট্রেলিয়াকে ঘরের মাঠে হারানো— সবই ছিল। তাঁর ঝুলিতে ২১টি টেস্ট জেতার রেকর্ড!

হ্যাঁ, ‘দাদা’র ভূমিকাই নিয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

আইপিএল-এর মাঠে যখন মুখোমুখি।

এর বছর দুয়েক পরে ‘দাদা’র হাত থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন তুলে নেন ধোনি। তবে, তিনি যেন সৌরভের ঠিক উল্টো। উচ্ছ্বাসের কোনও বহিঃপ্রকাশ নেই। নেই আক্রমণাত্মক কোনও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। মাঠে নেমে ঠান্ডা মাথায় চুপচাপ ‘কাজ’ করে যাওয়াটাই যেন ধর্ম। তত দিনে ভারতীয় ক্রিকেট ফের তার সেরা সময়ের মুখ দেখতে শুরু করেছে। ১৯৮৩-র পর ফের ভারতে বিশ্বকাপ এল ২০১১-য়। এবং সেটা ধোনির হাত ধরেই। পরের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালেও পৌঁছেছিল ভারত। এর বাইরে ধোনির ভারত আইসিসি-র প্রায় সমস্ত টুর্নামেন্টে জিতেছে। তাঁর অধিনায়কত্বেই আইসিসি র‌্যাঙ্কিং-এ এক নম্বর টেস্ট দল হয়েছে ভারত। সেটাই আবার ফিরে এসেছে বিরাট কোহালির সময়ে। অধিনায়ক ধোনির রেকর্ডের তালিকায় রয়েছে টানা ১১টি টেস্টে অপরাজিত থাকার রেকর্ড। তিনি সফলতম ভারত অধিনায়ক, যাঁর ঝুলিতে রয়েছে ২৭টি টেস্ট জয়ের রেকর্ড।

আরও খবর: একটাও ‘নো বল’ করেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে! কারা জানেন?

দাদার ব্যাটন হাতে নিয়ে ‘কুললি’ তা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এমএস ধোনি।

ভারতীয় ক্রিকেটের এই দুই সফলের মধ্যে তুলনা হয়তো চলে না। কিন্তু, জন্মদিনের আগে পরিসংখ্যান ঘাঁটতে গিয়ে বোঝা গেল শারীরিক উচ্চতার মতো এই দুই ক্রিকেটারের সাফল্যের উচ্চতার লেভেলও প্রায় একই। ‘উনিশ-বিশ’।

(৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, এই প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় এতে কয়েকটি তথ্যগত ত্রুটি ছিল। পাঠকদের ধন্যবাদ, তাঁরা সেই ত্রুটিগুলির প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। বিশ্বকাপ ২০১১-র ফাইনালে ধোনি-ইশান্ত জুটির কথা লেখা হয়েছিল যা ঠিক নয়। শেষ ওভারে ১৫ রান দরকার ছিল বলে যা লেখা হয়েছিল তাও ঠিক নয়। সৌরভ গাঙ্গুলিকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম বাঙালি অধিনায়ক বলে লেখা হয়েছিল। কিন্তু সৌরভের আগে আর এক বাঙালি একটি টেস্টে দেশের অধিনায়কত্ব করেছিলেন। তিনি পঙ্কজ রায়। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিগুলির জন্য আমরা দুঃখিত।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন