(বাঁ দিকে) রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
গৌতম গম্ভীর যা বলেছিলেন তাকে হাত কামড়ানোই বলে। গুয়াহাটি টেস্টে হেরে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে চুনকাম হওয়ার পর ভারতীয় দলের কোচ বলেছিলেন, বিরাট কোহলি এবং রোহিত শর্মার টেস্ট ক্রিকেট থেকে হঠাৎ অবসরের পর একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সঙ্গে রবিচন্দ্রন অশ্বিনেরও সরে যাওয়া। এরকম সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটকে আগে কখনও যেতে হয়নি।
নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে কোহলি এবং রোহিত। খোদ অশ্বিন মনে করছেন দুই সিনিয়র ব্যাটার থাকলে ভারতীয় দলের এমন দুরবস্থা হত না। বিপরীত মেরুতে সুনীল গাওস্কর। তাঁর মতে, এই দু’জন থাকলেও বিশেষ লাভ হত না। লাভ-ক্ষতির আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, রোহিত আর কোহলি যে অবস্থায় টেস্ট ছেড়েছেন, তাতে তাঁরা এই দলে সুযোগ পেতেন কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন।
গম্ভীর ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার পর একে একে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন অশ্বিন, কোহলি এবং রোহিত। গত অস্ট্রেলিয়া সফরে শেষ টেস্ট খেলেন তিন জন। প্রশ্ন, সত্যিই কি কোহলি-রোহিতেরা পার্থক্য তৈরি করতে পারতেন? ঘটনা হল, টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ার আগে দীর্ঘ দিন ধরে লাল বলের ক্রিকেটে ফর্মের ধারে-কাছে ছিলেন না দুই সিনিয়র ব্যাটার।
কোহলি শেষ ১৫টি টেস্টে করেছেন ৮১৪ রান। গড় ৩২.৫৬। শতরান মাত্র ২টি। শেষ ১০টি করে টেস্ট ধরলে কোহলির গড় আরও খারাপ, ২২.৪৭। শুধু ঘরের মাঠে শেষ পাঁচটি টেস্টে কোহলির রান ১৯২। একটিও শতরান নেই। গড় ২১.৩৩।
রোহিতের অবস্থা আরও খারাপ। তাঁর শেষ ১৫টি টেস্টে গড় ২৩.১১। শেষ ১০ টেস্টের গড় ১৮। শুধু ঘরের মাঠে শেষ পাঁচটি টেস্টে রোহিতের রান ১৩৩, গড় ১৩.৩০।
শোনা যায়, গম্ভীরের জন্যই টেস্ট ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দু’জনে। গাওস্কর একমত নন। বলেছেন, ‘‘অবসরের সিদ্ধান্ত অবশ্যই সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়ের নিজস্ব। তবে তাকে কেউ পরামর্শ দিতেই পারে। মনে হতে পারে, ওদের অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই ভাবনাটা সঠিক নয়।’’
রো-কো জুটি থাকলেই যে ভারত হাসতে হাসতে জিতত, একেবারেই মনে করছেন না তিনি। পরিসংখ্যান তুলে ধরেই তাঁর যুক্তি, ‘‘ওরা তিন জন থাকলেই আমরা সিরিজ় জিততাম, তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা তো নিউ জ়িল্যান্ডের কাছেও ০-৩ ব্যবধানে হেরেছি। তখন তো দলে ওরা তিন জনই ছিল। অস্ট্রেলিয়া সফরেও তো লাভ কিছু হয়নি।’’
টেম্বা বাভুমার দল ভারতকে লাল বলের ক্রিকেটে চুনকাম করার পর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে অশ্বিন বলেছেন, কোহলি এবং রোহিতকে এই পালাবদলের পর্বে প্রয়োজন ছিল। কিছুটা সময় নিয়ে বদল করা যেত। তিনি বলেছেন, ‘‘পরিবর্তন বা পালাবদলের নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকা উচিত। এই পদ্ধতির মধ্যে স্বচ্ছতা না থাকলে বিষয়টাকে ব্যক্তিগত এবং স্বাধীন সিদ্ধান্ত মনে হয়। কোহলি দলে থাকলে তরুণদের সাহায্য করতে পারত। রোহিতও সাহায্য করতে পারত। আমিও করতে পারতাম। অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারতাম আমরা।’’
কিন্তু তাঁরা থাকতেও নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে ঘরের মাঠে প্রথম বার সিরিজ়ের সব টেস্ট হারতে হয়েছিল ভারতীয় দলকে। সেই সিরিজ়েও তাঁদের পরামর্শ পেয়েছিলেন তরুণ ক্রিকেটারেরা। লাভ কিছু হয়নি।
সাই সুদর্শন, ধ্রুব জুরেল, নীতীশ রেড্ডির মতো জুনিয়র ক্রিকেটারদের ব্যর্থতা নিয়ে এখনই গেল গেল রব তোলা যুক্তিসঙ্গত নয়। সুদর্শন ছ’টি, জুরেল ন’টি এবং নীতীশ ১০টি টেস্ট খেলেছেন। পর্যাপ্ত সময় তাঁদের প্রাপ্য। কিন্তু তাই বলে রোহিত-কোহলিকে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ় উতরানো যেত, এমনটা ভাবার কারণ নেই।
কোহলি-রোহিতকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে নারাজ বাংলার দুই প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ও। দু’জনেরই বক্তব্য, শেষ দু’তিন বছরে কোহলি-রোহিত আহামরি কোনও পারফরম্যান্স করতে পারেননি। সম্বরণ বললেন, বক্তব্য, ‘‘কোহলি-রোহিত থাকলে ভাল হত, এ সব ভাবনার মানে নেই। ওরা নিশ্চই বড় ক্রিকেটার। দীর্ঘ দিন খেলেছে। কিন্তু একটা সময় থামতেই হয়। ডন ব্র্যাডম্যান কি আজীবন খেলে গিয়েছেন? পরিবর্তন তো করতেই হবে। এখন যারা খেলছে, তারা কেউ খারাপ ক্রিকেটার নয়। ভারতীয় দল খারাপ খেলেছে, তাই হেরেছে।’’
রোহিত-কোহলি থাকলে কী হতোর থেকেও বেশি প্রশ্ন তোলা উচিত, গম্ভীরের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে। রাহুল দ্রাবিড়, চেতেশ্বর পুজারার পর এখনও পর্যন্ত টেস্টে নির্দিষ্ট তিন নম্বর ব্যাটার খুঁজে পায়নি ভারত। রবি শাস্ত্রীর কথায়, গম্ভীরের জমানায় টেস্টের ব্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বর জায়গা ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’-এ পরিণত হয়েছে।
গম্ভীর কোচ হওয়ার পর ভারতের ১৮টি টেস্টে সাত জন ব্যাটার খেলেছেন তিন নম্বরে। দ্রাবিড়ের পর গম্ভীর যখন দায়িত্ব নেন তখন টেস্টে তিন নম্বরে খেলতেন শুভমন গিল। রোহিত-বিরাট অবসর নেওয়ার পর চার নম্বরে নেমে যান শুভমন। ফলে তিন নম্বর ফাঁকা হয়ে যায়। তার পরেই শুরু হয় ‘মিউজ়িক্যাল চেয়ার’।
সম্বরণ ঠিক এটাই বললেন, ‘‘লাল বলের ক্রিকেটে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এত পরীক্ষা করার জায়গা থাকে না। ওয়াশিংটন সুন্দর কেন তিন নম্বরে ব্যাট করবে? এটা হয় না। টেস্টে তিন নম্বরে ব্রায়ান লারা, রাহুল দ্রাবিড়েরা ব্যাট করত। এক দম বিশেষজ্ঞ ব্যাটারের জায়গা। যাকে যেখানে খুশি নামিয়ে দিলেই হয় না। ভাবনা বদলাতে হবে।’’
রোহিত-কোহলি নন, বরং শুভমনের না থাকাটা ভারতের হারের কারণ বলছেন স্নেহাশিস। তিনি বললেন, ‘‘কোহলি-রোহিত থাকলেই ভাল ফল হত— এটা একদম ভুল ভাবনা। আমার তো মনে হয়, শেষ তিন বছরে কোহলির টেস্ট গড় ৩০-এর আশেপাশে হবে। কী লাভ হয়েছে? এটাই এখন ভারতের সেরা দল। আমরা ভাল খেলতে পারিনি, তাই হেরেছি। বরং শুভমনের না থাকাও কারণ।’’
সম্বরণের মতো সিএবির প্রাক্তন সভাপতি গম্ভীরের আরও একটি ত্রুটি তুলে ধরলেন। স্নেহাশিস বললেন, ‘‘দল নয়, আমাদের থট প্রসেস বদলাতে হবে। জানি না, কেন আমরা স্পিন সহায়ক পিচে টেস্ট খেলছি। আমি এটা গত বছরই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের বৈঠকে তুলেছিলাম। এখন ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনও ম্যাচ এ রকম পিচে খেলা হয় না। দেশের সব জায়গায় এখন শক্ত উইকেট। ভাল বাউন্স থাকে। তরুণ খেলোয়াড়েরা সেটাতেই অভ্যস্ত।’’
সম্বরণ-স্নেহাশিসদের সময় সারা দেশ খুঁজলে জাভাগল শ্রীনাথ, প্রশান্ত বৈদ্যের মতো তিন-চার জন ১৪০ কিলোমিটার গতির জোরে বোলার পাওয়া যেত। এখন বাংলা দলেই মহম্মদ শামি, আকাশ দীপ, মুকেশ কুমার, ঈশান পোড়েলরা ভাল গতিতে বল করেন। সব দলে দু’-তিন জন ১৪০ কিলোমিটার গতির বোলার রয়েছে। স্নেহাশিস বললেন, ‘‘এখন আমাদের দেশে প্রচুর পেসার। তা ছাড়া ২৫-৩০ বছর আগের ভারতীয় স্পিনারদের সঙ্গে এখনকার স্পিনারদের তুলনা করলে হবে না। তা-ও আমরা স্পিন সহায়ক পিচে খেলব! ইংল্যান্ডে কি আমাদের এ রকম পিচ দেওয়া হয়েছিল? দল তো ভালই খেলেছিল। ভাবনা বদলাতে হবে।’’
প্রধান নির্বাচক অজিত আগরকর একাধিক বার বলেছেন, তাঁরা এমন দল তৈরি করতে চাইছেন, যে দল আগামী ১০-১৫ বছর দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। কোচ গৌতম গম্ভীরও ভারতীয় দলের পালা বদলের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন একাধিক বার। দু’একটি ম্যাচে ব্যর্থ হলেই তরুণ ক্রিকেটারদের ছেঁটে ফেলার পক্ষে নন তিনি।
তা হলে ২৫-৩০ গড় নিয়ে রোহিত-কোহলি এই দলে ঢুকতেন কী করে, থাকছে প্রশ্ন। উদ্ধার করতে পারা বা না পারা অনেক পরের ব্যাপার।