মাঠে আগুন। ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকদের ছোড়া মশাল থেকে। ছবি: এপি।
ভয়াবহ ছবিগুলোর কোনওটা ইতিমধ্যেই ভাইরাল, কয়েকটা আস্তে আস্তে জায়গা নিচ্ছে আতঙ্ক-সরণিতে।
লিলের রাজপথে আজ আর ফুটবল-মাদকতা নামের শব্দ নেই। ওখানে এখন ফ্লেয়ার গান হাতে কালো পোশাকধারীদের ভিড়। ওঁরা সবাই ফরাসি পুলিশ, কর্ডন করে অনন্ত অপেক্ষায় উগ্র ইংরেজ সমর্থকের। এক চুল বেয়াদপি মানে সোজা ফ্লেয়ার গানের ঝলকানি।
রক্তের রেললাইন নাক থেকে মুখ, কপাল থেকে গাল বেয়ে চুঁইয়ে নামছে নীচের দিকে। ফুটবল-হিংসায় আক্রান্ত এক ইংরেজ সমর্থকের ছবিটা ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে বহু দিন। প্রচুর আন্তর্জাতিক কাগজ-ম্যাগাজিন তুলে ছাপিয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো ব্যবহার হবে আবার। এটা রাশিয়ান আল্ট্রার হাতে মার।
সবুজ মাঠে পর পর আগুন-মশালের শুয়ে থাকা দেখলে ভ্রম হয়। মনে হয়, এটা ফুটবল না দীপাবলি? চমক ভাঙে ক্রোট প্লেয়ারদের ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে যাওয়া দেখলে, সমর্থকদের কাছে কাতর অনুনয়ের আর্তির ভাষা শুনলে। মশাল জ্বালিয়ে দীপাবলি নয়, প্লেয়ারদের দিকে মশাল ছুড়ে মাঠকে নরক করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
ইউরো কাপ আজ থেকে হচ্ছে না। ৫৬ বছর ধরে হচ্ছে। কিন্তু নারকীয়তায়, অনভিপ্রেত ঘটনাবলীর স্রোতে ফ্রান্স-২০১৬ বোধহয় অতীতের সব ক’টির চেয়ে আলাদা। যেখানে দিমিত্রি পায়েতের গোলকে বেশি ক্ষণ মনে রাখা যাচ্ছে না, অবচেতনে ঢুকে পড়ছে ইংরেজদের দাঙ্গার ভয়। ইনিয়েস্তাদের তেইশ পাসের গোল উপভোগ করা যাচ্ছে না, বিবর্ণ বসে থাকতে হচ্ছে রুশ আল্ট্রাদের খুনোখুনির টেনশনে। কেভিন দে ব্রায়েনের ম্যাচের পর ম্যাচ ধরে অসম্ভব ওয়ার্কলোড, কন্তের হাত ধরে ইতালির পুনর্জন্ম, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিম নিয়েও জোয়াকিম লো-র দুশ্চিন্তা ভরা মুখচোখ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর নিজেকে ফিরে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছে, আইসল্যান্ডের ইতিহাস— পাবলো পিকাসোর দেশে কোনওটাই তো আর খবর নয়। আতঙ্কের লোহিতকণায় সব অদৃশ্য, সব যেন গুরুত্বহীন।
জীবন বিপন্ন করে কবিতা লেখা যায় কখনও?
এই তো, কুড়ি জন রুশ সমর্থককে প্রায় ঘাড় ধরে দেশ থেকে বার করে দিল ফ্রান্স ইংরেজ সমর্থকদের বেধড়ক মারার অপরাধে। কুখ্যাত আল্ট্রা টিমের নেতা আলেকজান্ডার ফ্রাইজিন-ও রয়েছে তাদের মধ্যে। মার্সেইয়ের দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য ৪৩ জন উগ্র রুশ সমর্থককে গ্রেফতার করেছিল ফরাসি পুলিশ, সমর্থক সংগঠনের নেতা আলেকজান্ডারও ছিলেন তাতে। তবু তো ২০ জন মস্কো ফিরতে পারলেন, বাকিদের মধ্যে তিন জনকে এখন দু’বছর জেলে পচতে হবে। আসলে রক্ত ঝরিয়ে যে টুর্নামেন্টের শুরু, যেখানে প্রথমেই ইংরেজ সমর্থকদের মেরে রক্তাক্ত করে দিয়েছিল ফরাসি সমর্থকরা, সেই টুর্নামেন্টের মধ্যভাগে গোলাপ পাপড়ির সৌন্দর্য থাকবে কী ভাবে? বেল-পায়েতদের মোহিনী ফুটবলে মন ডুববে কি করে? আর শুধু তো রুশরা নয়, ইংরেজরা নয়, ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা
পর্যন্ত জঙ্গিপনায় নেমে গেল শুক্রবার রাত থেকে।
ভাল করে বললে, নারকীয়তার নতুন সংস্করণ উপস্থিত করে।
উয়েফা ইতিমধ্যে সাঁ এঁতিয়েনে সমর্থকদের চরম বিশৃঙ্খল আচরণ দেখে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ নিয়ে বসে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত উয়েফা যদি শাস্তির দিকে যায়, ক্রোয়েশিয়ার টুর্নামেন্ট ভাগ্যে কী হবে বলা যায় না। গত রাতে চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ম্যাচের শেষ দিকে আচমকাই মাঠে পর পর মশাল পড়তে থাকে। অবশ্যই তা গ্যালারি থেকে উড়ে আসছিল। গ্যালারিতে মারামারি লেগে যায়, গায়ে মশাল আছড়ে পড়া থেকে কোনও রকমে নিষ্কৃতি পান ক্রোয়েশিয়ার গোল স্কোরার ইভান পেরিসিচ। এক জন মাঠকর্মীও পুড়তে পুড়তে বাঁচেন। রেফারি যা-দেখে বাধ্য হন মিনিট চারেক ম্যাচ বন্ধ রাখতে। ক্রোট প্লেয়ারদের ছুটে যেতে দেখা যায় গ্যালারির দিকে, সমর্থকদের শান্ত হওয়ার অনুরোধ করেন তাঁরা। বাজি পোড়ানো, বিভিন্ন জিনিস মাঠে ছুড়ে মারা, গ্যালারিতে অশান্তি সৃষ্টি— ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে তিনটে অভিযোগ তো উঠেছে। সঙ্গে উঠেছে বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগও। কারণ ম্যাচের সময় ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকরা ফ্যাসিস্ট গান গাইছিলেন, নাৎসি ব্যানার তুলে ধরছিলেন। অনেকে নিজেদের ‘নিও নাৎসি’ বলে পরিচয় দিতেও ভালবাসেন। তুরস্ক— তারাও সমর্থকদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে। এক সমর্থক স্পেন-তুরস্ক ম্যাচের শেষে মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন। কিন্তু ক্রোটদের বন্যতার পাশে ওটা নিতান্ত দুধের শিশুর কাণ্ড।
বর্বরতার কুৎসিত বিজ্ঞাপন দেখে স্বয়ং ক্রোয়েশিয়া কোচই মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না। টিম তাঁর, সমর্থন তাঁর, কিন্তু ম্যাচ শেষে আন্তে ক্যাসিচ ফেটে পড়ে বলে দিয়েছেন, ‘‘এরা কেউ ক্রোয়েশিয়া সমর্থক নয়। এদের কাউকে আমি ক্রোয়েশিয়ার সমর্থক বলব না। এরা এক এক জন হুলিগান, যাদের দেখে ভয় লাগবে!’’ ফুটন্ত ক্রোয়েশিয়া কোচের মনে হচ্ছে, এমন জঘন্য আচরণে পঁচানব্বই শতাংশ ক্রোয়েশিয়া সমর্থকের মাথা নিচু হয়ে গেল। ‘‘এরা সমর্থক? এদের সমর্থক বলে? এরা এক-এক জন জঙ্গি। স্পোর্টস টেররিস্ট,’’ ছিটকে বেরিয়েছে ক্যাসিচের বীতশ্রদ্ধ গলা থেকে। ক্রোয়েশিয়া ফুটবল সংস্থার কাছে এদের চরম শাস্তির আবেদন তুলেছেন তিনি। টিমের মিডফিল্ডার ইভান র্যাকিটিচ, বার্সেলোনার যিনি পরিচিত মুখ তাঁকে তিতিবিরক্ত ভাবে পরে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের এখন উয়েফার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চেক রিপাবলিকের কাছে চাইতে হবে। গোটা বিশ্বে যাঁরা ফুটবল ভালবাসেন, সবার কাছে চাইতে হবে ক্ষমা।’’
বিবিসি রেডিও আবার ক্রোয়েশিয়ার এক সাংবাদিককে নিয়ে এসেছিল, যিনি পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছেন। ভয়ার্ত ভাবে তাঁকে বলতে শোনা যায় যে, প্রথমে নাকি কিছু বোঝা যায়নি। টিম খেলছিল ভাল, দর্শকরাও শান্ত ছিল। কিন্তু আচমকাই ওই সাংবাদিক দেখতে পান, প্রচুর পুলিশ গ্যালারির দিকে ছুটে আসছে। কারণ তত ক্ষণে চোখের সামনে তুমুল মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। কেন, কোন যুক্তিতে— সে সব ছাড়াই। অ্যান্ডি মিতেন নামের ওই সাংবাদিক রেডিওয় কথা বলার সময়ও প্রায় কাঁপছিলেন। বলছিলেন, ‘‘বীভৎস ব্যাপার। চোখে দেখা যায় না!’’
ক্রোয়েশিয়ার পূর্বতন কোচ স্ল্যাভেন বিলিচ অশান্তির শেষ এখানেই দেখছেন না। বলছেন, এ জিনিস আবার ঘটতে পারে। আবার ক্রোট সমর্থকদের নারকীয়তা দেখতে হতে পারে। কারণ বেশ কিছু সমর্থক ফ্রান্স যাচ্ছেই ঝামেলা বাঁধাতে। রাতের দিকে আবার খবর এল, বেলজিয়ামে সন্ত্রাসের আশঙ্কা করে জনা চল্লিশেক সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেলজিয়াম সরকারের আশঙ্কা, শনিবার সন্ধেয় বেলজিয়াম বনাম আয়ার্ল্যান্ড ম্যাচে সন্ত্রাস হতে পারত।
কোথাও ফুটবল নেই। শিল্পের দেশে কোথাও শিল্পের হাত ধরে ফুটবলের হেঁটে যাওয়া নেই। ফুটবল যেন শুধু স্টেডিয়াম আর টিভিতে সীমাবদ্ধ, অশান্তির দেওয়াল টপকে যার গোটা ফরাসি মননে ছড়িয়ে যাওয়ার হুকুম নেই। স্যেন নদী বিধৌত ফ্রান্স এখন ছবি নয়, কবিতার নয়— রক্তনদীর দেশ!