ধোনির ছক্কায় ভারতের এশিয়া জয়

ক্রিকেট কাকে বলে ব্যাখ্যা করুন? রোববার রাতে একটা ফেসবুক পোস্ট দেখলাম। পোস্টটাতেই অবশ্য উত্তর দেওয়া রয়েছে। ক্রিকেট হল সেই খেলা যেখানে দুটো টিম খেলে আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি উইনিং স্ট্রোক মারেন

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩০
Share:

শেষ বেলায় ধোনি ঝ়ড়। রবিবার বাংলাদেশের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে। ছবি: এএফপি।

বাংলাদেশ ১২০-৫ (১৫ ওভার) ভারত ১২২-২ (১৩.৫ ওভার)

Advertisement

ক্রিকেট কাকে বলে ব্যাখ্যা করুন? রোববার রাতে একটা ফেসবুক পোস্ট দেখলাম।

পোস্টটাতেই অবশ্য উত্তর দেওয়া রয়েছে। ক্রিকেট হল সেই খেলা যেখানে দুটো টিম খেলে আর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি উইনিং স্ট্রোক মারেন।

Advertisement

পোস্টটায় আসলে অসম্পূর্ণ। আরও একটা লাইন যোগ হওয়া উচিত ছিল যে, উইনিং ছক্কাগুলো মেরেও ধোনি নির্লিপ্ত থাকেন। রোববার যেমন ম্যাচ জেতার পরমুহূর্তে জনতার বিচারে টুর্নামেন্ট সেরা বিরাট কোহালি ডাগআউটের দিকে হাত ঝাঁকিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। তিনি, ধোনি সম্পূর্ণ উদাসীন। ঔদাসীন্যটাই কি তাঁর আজকের জবাব সেই ফেসবুক পোস্টটার, যেখানে তাসকিনের সঙ্গে তাঁকে খুব কুশ্রী ভাবে দেখানো হয়েছিল? ধোনির হাবভাব দেখে যথারীতি মনে হল তাঁর এ সবে কিছু আসে যায় না।

এ সবের মধ্যে আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। পুরস্কার বিতরণ হচ্ছিল এমন ফাঁকা গ্যালারিতে যে মনে হবে কোনও শুটিং ইউনিট বুঝি ক্রিকেট পুরস্কার দেওয়ার শুটিং করছে। ওই খালি গ্যালারিটা অবশ্যই বাংলাদেশি হাহাকার। আর ওটাই হয়তো গত দু’বছর এখানে হারা ধোনির জবাব।

অথচ উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় ভারতীয় ইনিংসের মাঝপথে মনে হচ্ছিল বড় বেশি ডট বল খেলছে টিম ইন্ডিয়া। বড় রানের জন্য সর্বাত্মক বোমারু হানা কোথায়? এত সিঙ্গলস আর মাঝে মাঝে এক-আধটা চার। পরে দেখা গেল ওটা ছিল শীতল পেশাদারিত্ব। সাবেকি ঘরানায় হাতে উইকেট রেখে কিছু পরে চার্জে যাওয়া। বাংলাদেশ আবেগ ও উদ্যমে ভর দিয়ে যথেষ্ট লড়াই দিয়েছে। কিন্তু দুটো টিমে গুণগত স্কিলের একটা প্রবল পার্থক্য তো আছেই। সেটাই টাইগারদের অসম্ভব স্বপ্নের অভিযানকে স্তব্ধ করেছে। একটা জায়গায় গিয়ে যে স্কিল আবেগকে ছাড়িয়ে পরের ফ্লাইওভারে উঠে যাবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ। যদি না মারাত্মক কোনও অঘটন হয়! মীরপুর সেটা ঘটায়নি বলে ফাইনালটা কিছু দূর গিয়ে একপেশেই হয়ে পড়ল। অথচ শুরুর সঙ্কেত অন্য রকম দেখাচ্ছিল।

শিখর ধবন নন।

সুরেশ রায়না নন।

এমনকী বিরাট কোহালিও না।

এই ভারতীয় ব্যাটিং লাইন আপে বিপক্ষকে চরম হতাশ করে দেওয়ার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ ব্যাট রোহিত শর্মা। তিনি যখন দ্বিতীয় ওভারের মধ্যে স্লিপ ক্যাচে আউট, ম্যাচটা হঠাৎ এতক্ষণের গতিবিধি হারিয়ে সমান-সমান স্তরে চলে গেল। ধবন এমনিতেই ফর্মে নেই। তার ওপর ডট বল খেলে চলেছেন। কোহালিরও সেই রাজসিক উপস্থিতি কোথায়! সিঙ্গলসের ওপর খেলছেন।

তা হলে কি মাত্র ১৩ বলে নট আউট ৩৩ রানের ইনিংসটাই হয়ে যাবে ম্যাচ নির্ণায়ক? তিনি, আইপিএল নিলামে উপেক্ষিত মাহমুদউল্লাহ হয়ে যাবেন ফাইনালের অতর্কিত নায়ক? না কি ৩ ওভারে মাত্র ১৩ রান দেওয়া ফাইনালের ইয়র্কার-সম্রাট বুমরাহ? এই সময় মাশরাফি আক্রমণে আনলেন আবু হায়দারকে। গতি তাসকিন বা আল আমিনের চেয়ে কম কিন্তু ওয়ান ডে-তে খুব কার্যকরী। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে সবচেয়ে বেশি উইকেটও পেয়েছেন হায়দার। তাঁর ওভারে কোহালি একটা উঁচু ড্রাইভ তুললেন মিড অফের ওপর দিয়ে। মিড অফ ফিল্ডারের দু’হাত পেছনে পরে বলটা চার হয়ে গেল। একই ভাবে সেঞ্চুরিয়নের বিশ্বকাপ ম্যাচে বেঁচে যান সচিন। সে দিন যেমন দু’হাত তফাত হয়ে গেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। এশিয়া কাপ ফাইনালেও একই জিনিস ঘটল। ওই ওভারটায় এল ১৪ রান। সাকিবের পরের ওভারে ১৫। তখনই জানা হয়ে গিয়েছে ম্যাচ দেখতে বসা আর কারও হৃদস্পন্দন বিপন্ন হবে না।

এমন উগ্র, উচ্চকিত গণসমর্থনের বিরুদ্ধে ভারত শেষ কবে খেলেছে? মীরপুর প্রেসবক্সে বসে হাতড়ানোর চেষ্টা করছিলাম।

সম্ভবত সিডনির সেই কুখ্যাত মাঙ্কিগেট টেস্টে। বাংলাদেশে ভারত তো গত ক’বছরে বেশ কয়েক বার খেলল। এমনকী ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেও। কিন্তু এ বারের তীব্রতা একেবারে অন্য রকম। অশ্বিনকে প্রথম ওভারে যখন তামিম মারতে পারছেন না। যখন জাডেজাকে লিফ্ট করতে গিয়ে প্রথম বলেই মাশরাফি আউট। শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামের গ্যালারি দীর্ঘশ্বাসের যোগফল নিশ্চয়ই ফারাক্কাতেও
শোনা গিয়েছে।

মাহমুদউল্লাহ যখন পাল্টা আক্রমণে হার্দিককে ছিঁড়ে ফেলছেন তখন আবার মনে হল মৃত স্বপ্নের আগ্নেয়গিরি থেকে আচমকা লাভা নিঃসরণ শুরু হল!

বৃষ্টিতে কমে আসা ম্যাচ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী টিমের পক্ষে সব সময় বেশি বিপজ্জনক। ধোনি টস জিতে সেই সমস্যার খানিকটা সুরাহা করেছিলেন। বাকিটা করল তাঁর বোলিং ইউনিট এবং টিমের সামগ্রিক পেশাদারিত্ব। জসপ্রীত বুমরাহ চাপের মুখে অনবদ্য বল করলেন। যেমন তাঁর ভাল ইয়র্কার তেমন অতর্কিত শর্ট বল। চোদ্দোতম ওভারে হার্দিকের দেওয়া ২১ রানের অপর্যাপ্ত খরচা বুমরাহর শেষ ওভারে শুকিয়ে হল মাত্র ৭ রান। শেষ ওভারেই কি তিনি চূড়ান্ত ভাবে খেলা ঘুরিয়ে দিলেন ভারতের দিকে?

তখনও বোঝার উপায় নেই। কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে অতিথিদের রান তাড়া করার অধ্যায় আজ আরও মর্মস্পর্শী হতে পারে স্থানীয় ব্যাকুলতার মধ্যে। কেন?

শনিবার রাত্তিরে ঢাকা শহরের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল এশিয়া কাপ ফাইনাল ভুল বলছে সংগঠকেরা। ওটা আসলে বিশ্বকাপ ফাইনাল। এ দিন সকাল থেকে বোঝা গেল বিশ্বকাপ ফাইনালও নয়, মীরপুরে রোববার সন্ধেবেলা বুঝি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। রাস্তায় জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল। ফুটপাথের ধারে ক্রিকেট-জটলা। এফএম শো-এ স্রোতাদের মেল পড়ে শোনাচ্ছেন আরজে-রা।

গান চাই না আজ কথা চাই কথা, শুধু ক্রিকেটের কথা। নিউজ টেলিভিশনগুলোও তখন মাঝে মধ্যে দেশাত্মবোধক গান শোনাচ্ছে।

কুড়ি ওভারের ক্রিকেট বোধহয় তার আবির্ভাব লগ্ন থেকে কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি যেখানে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটও হয়ে গিয়েছে সীমান্তের জাতীয় যুদ্ধ! ঢাকা মাঠের জলনিকাশি ব্যবস্থা যে ইডেনের তুলনায় শতগুণে ভাল, সেটা আবার প্রমাণ হওয়ার মধ্যেই এ দিন আরও একটা ছোট যুদ্ধজয়।

ক্যাকোফোনি আর ক্যাঁচরম্যাচরে ইডেন প্রেসবক্সের জুড়ি পাওয়া কঠিন। এ দিন অবশ্য ঢাকায় সব কিছুই এমন উগ্র দেশজ চাহিদায় চোবানো যে, ইডেন পাশের বাড়ির খোকন। বাংলাদেশ ইনিংসে প্রতিটি বাউন্ডারির সঙ্গে চিৎকার-উচ্ছ্বাস। সাকিব মনে হচ্ছিল ম্যাচটা ধরে নিয়েছেন। অশ্বিন তাঁদের পার্টনারশিপটা ভেঙে দিলেন। ওটা ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

আর একটা আকর্ষণীয় সাইডলাইট হল, বাংলাদেশ জনতা যখন রোববারের ফাইনাল ঘিরে এক রকম জাতীয়তাবাদের অঘোষিত ডাক দিয়ে দিয়েছে, কোহালিদের দেখাচ্ছিল খুব নির্লিপ্ত। ভাবটা এমন যে, আমরা বড় ফাইনাল অনেক খেলেছি। এটা আর পাঁচটা ফাইনালের মতোই। বা আরও এক ধাপ এগিয়ে আরও একটা সাধারণ ম্যাচ। জিততে হবে এ ছাড়া এই ম্যাচ ঘিরে আর কোনও বাধ্যবাধকতা বা বৈশিষ্ট্য উপস্থিত নেই। সকালে হোটেলের পনেরো তলার রেস্তোরাঁয় বিরাট কোহালিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বুঝলাম চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে গেল। টিম ইন্ডিয়া সত্যিই অবিচলিত। একটা পাঁচতারা হোটেলের রেস্তোরাঁ যেখানে প্লেয়ারদের জন্য সংরক্ষিত কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি— সেখানে কোহালি কোনও নিরাপত্তারক্ষী-টক্ষী ছাড়া এ ভাবে ফাইনালের দিন ঘুরছেন। লোকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, ছবি তুলছে, মানে তো ফুরফুরে মেজাজ টিমের।

ধোনি প্রথম ওভার অশ্বিনকে দিয়ে শুরু করার মতোই একটা চমক ধেয়ে এল পরের দু’ঘণ্টায়। যখন লাঞ্চ টেবলের চেহারাটা দেখলাম। এই ক’দিন ম্যাচ ডে-তে টিমের সাধারণ রুটিন ছিল দুপুর তিনটে অবধি লাঞ্চ আর গল্পগুজব করে আস্তে আস্তে ঘরের দিকে যাওয়া। সাড়ে সাতটায় ম্যাচ শুরু, তাতেও মধ্যিখানে অনেক সময়। অথচ আজ প্লেয়ার ছেড়ে দিচ্ছি, সাপোর্ট স্টাফেরও দেখা নেই। ফ্যাভোলা কফিশপ কাম রেস্তোরাঁর কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা জানালেন, আজ ওঁরা সবাই রুম সার্ভিস অর্ডার করেছেন।

একটু পরে ফোনে টিমের একজনের মুখে শুনলাম ঢাকা ব্লুজ যে করে হোক কাটাতেই হবে। দ্রুত মনে পড়ে গেল শেষ তিনটে টুর্নামেন্টেই ভারত এখানে হেরে ফিরেছে। ধোনির জীবনে ঢাকা লাকি শহর হিসেবে কখনও স্বীকৃত নয়। বোঝা গেল ঢাকা ব্লুজ কথাটা তা হলে টিম ইন্ডিয়ার অন্দরমহলে শিরশিরানি যেটা তারা বাইরে আসতে দিচ্ছে না। কালবৈশাখী, বিদ্যুৎ চলে যাওয়া, মাঠে জমা জল সব পেরিয়ে যখন মাঠের ধারে ধোনিদের হাডল চলছে, আর এক চমক!

টিমের উদ্দেশে কথা বলছেন রবি শাস্ত্রী। যাঁকে মাঠে ঢুকে হাডলে যোগ দিতে ক’মাসে এক বারও দেখিনি। শাস্ত্রী পরে বললেন, ‘‘হাডলে ওদের বললাম গত বার বাংলাদেশ জেতার পর কী রকম সেলিব্রেশন করেছিল মনে আছে তো? মাঠে যাও। গেট দ্য ব্লাডি জব ডান!’’

তবে দুটো টিমের মধ্যে ওজনে ধোনিরা যতই এগিয়ে থাকুন, খেলা ছোট হওয়া মানে দুর্বলতর দলটা সুবিধে পেয়ে থাকে। কারণ স্কিলের মাত্রা কমে অনিশ্চয়তার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এখানেই ড্রেসিংরুমের ডরভয়হীন মনোভাবের পরীক্ষা। ধোনিরা কি সত্যি তাঁদের ডিরেক্টরের এবিপি ইন্টারভিউ অনুযায়ী ফিয়ারলেস? চূড়ান্ত পরীক্ষা তখন ১৫ ওভার দূরে! যার রেজাল্ট আউট হয়ে গেল ১৪ ওভারের মধ্যে।

ঢাকা ব্লুজ মোটামুটি তাঁর অধীনে ঘটা একটা সংক্রমণ। সেটা অধিনায়ক নিজেই কাটানোর দায়িত্ব নিলেন। চার নম্বরে রায়না নামবেন বলে অনেকক্ষণ প্যাড পরে বসা। হঠাৎ ধোনি নেমে পড়লেন। নিজে নামলেন না ডিরেক্টরের অনুরোধে, আমরা পরে জানব। কিন্তু শেষবেলায় ওই ওস্তাদের মার দরকার ছিল। তখনও তো ১২ বলে ১৯ বাকি। তা ধোনি এক ওভার আগেই খেলা শেষ করে দিলেন। ৬ বলে ২০ নট আউট থেকে।

ঢাকা এত যন্ত্রণা দিয়েছিল। সেখানেই তো ছক্কাগুলো আতসবাজির মতো উড়ে গিয়ে তাঁর মাথায় ঐশ্বর্যের মুকুট পরাল। এটাও তো আবেগ! এটাও তো যন্ত্রণার সুদসমেত উদ্ধার!

কে বলেছে ওটা বাংলাদেশিদেরই নিজস্ব সম্পত্তি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন