নায়ক প্রহ্লাদ। -নিজস্ব চিত্র
পঁচাত্তরের রাতটা আজও মনে আছে গৌতম সরকারের। টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জয়ের রাত। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রথমে, শেষে পাতে ইলিশ।
প্রহ্লাদ রায় দমদমের মেসে ফিরে মঙ্গলবার রাতে ইলিশ খেলেন বলে খবর নেই। বরং সেলিব্রেশনটা হল বিরিয়ানি দিয়ে। অবিনাশ রুইদাস আবার বাড়িতে নয়, অভিভাবকদের নিয়ে সোজা চলে গেলেন তারাতলার রেস্তোরাঁয়, পরে বজবজের বাড়ি। সেলিব্রেশনের মেনু একই। বিরিয়ানি।
চল্লিশ বছরে উৎসবের রসনা কি পাল্টে গেল লাল-হলুদে? ইলিশের জায়গায় এখন তা হলে বিরিয়ানি?
প্রশ্ন শুনে হাসেন গৌতম সরকার। “আরে না, না। ইস্টবেঙ্গলের ছেলে ইলিশ তো খাবেই। আজ না হোক, কাল খাবে। সময় এখন বদলে গিয়েছে, বুঝতে হবে। আর খাওয়া-দাওয়া পাল্টাক না, ছেলে দু’টোর খেলায় তো চেনা ইস্টবেঙ্গলের মাইরা ফ্যালামু-এর পুরনো আগুনটাই দেখলাম।”
আর্মান্দোর কথায়, এঁরা দু’জন ইস্টবেঙ্গলের ভবিষ্যৎ। প্রহ্লাদ আর অবিনাশ। সগর্বে ইস্টবেঙ্গল কোচ বলছিলেন, “আজ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন বাংলা ফুটবলে নতুন ছেলেদের বেশি দরকার।” বাহাত্তরের লিগজয়ী অধিনায়ক সুধীর কর্মকার আর্মান্দোর যে বক্তব্য সমর্থন করেন, প্রহ্লাদদের তুলে আনার জন্য ধন্যবাদ দেন লাল-হলুদ কোচকে। যে প্রহ্লাদ-অবিনাশের খেলা মুগ্ধ করে দেয় সমরেশ চৌধুরীর, মাঠে যাঁদের দাপট দেখতে দেখতে চল্লিশ বছরের পুরনো স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে শুরু করেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। সোশ্যাল নেটওর্য়াকিং সাইটে তো তাই দেখা গেল।
যাঁদের নিয়ে এত আলোচনা সেই অবিনাশকে দেখা গেল, ম্যাচ শেষে ড্রেসিংরুমে পায়ে বরফ ঘষছেন। বাঁ হাতে চে গেভারার উল্কি। সে দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করতেই বললেন, “মারাদোনার হাতে ওঁর উল্কি রয়েছে। তাই আমিও করালাম!” পরমুহূর্তে বেরিয়ে আসে আগুন, “মোহনবাগানে থাকার সময় বাবলুদা ভরসা রাখতে পারেননি। আর্মান্দো পেরেছেন। তাই পারফর্ম করতে পারছি।”
স্টেডিয়ামের বাইরে তখন পাঁচ বার লিগ জয়ের আনন্দে ঢাকের তালে উর্ধ্ববাহু হয়ে নৃত্য চলছে। সঙ্গে গান, “সিএফএলটা জিতে নিলাম/টার্গেট লিগ-আই/ওই মিশনটা পূরণ হলে এএফসিটাও চাই।” পাশ থেকে স্লোগান, “প্রহ্লাদ-অবিনাশ/ ফের গড়লাম ইতিহাস।” যা শুনে অবিনাশের চর্মশিল্পী বাবা শ্যাম রুই দাসের চোখের কোনা ভিজে, গলা ধরা। রোজ যাঁকে দেখা যায় চড়িয়াল বাজারে জুতো সারাই করতে।
ড্রেসিংরুমে তখন ‘ডুডু, ডুুডু’ উল্লাস। কোচ আর্মান্দো কোলাসো খালি গায়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে। তাঁকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদছেন এক ক্লাব সদস্য। ড্রেসিংরুমে স্নানঘর থেকে আসছে বালতি বালতি জল। সামনে টিমের যাকে পাওয়া যাচ্ছে তাঁর মাথাতেই ঢালা হচ্ছে। আইসবাকেট চ্যালেঞ্জের ঢঙে যেন ওয়াটারবাকেট চ্যালেঞ্জ!
আর্মান্দোকে জড়িয়ে আজ সদস্যরা কাঁদতেই পারেন। ৩১ অগস্ট বিকেল পর্যন্ত তাঁর দল লিগে প্রথম ম্যাচ হেরে পাঁচ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল। আর ষোল দিনের মাথাতেই লিগ জয়। সোমবার মোহনবাগান জেতার পর একটা চাপ ছিল জিততেই হবে। কিন্তু ফুটবলারদের মাথায় সেই চাপ ঢুকতে দেননি। যে কারণেই বোধহয় লাল-হলুদের আইকন ফুটবলার ডুডুকে বলতে শোনা গেল, “এই জয় কোচের। জুনিয়রদের। আমরা কেউ না।” র্যান্টি মার্টিন্সের আবার মনে হচ্ছে, মোহনবাগান ম্যাচটাই লিগের টার্নিং পয়েন্ট। “ডার্বিটা জেতার পরেই বুঝে গিয়েছিলাম লিগ জিততেই পারি। ওটাই টার্নিং পয়েন্ট। তবে এরিয়ানের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে সুবোধের গোলটাকে টার্নিং পয়েন্ট টু বলতেই হবে। আর নীতুদার জন্য লিগ জয়ের একটা বাড়তি তাগিদ ছিলই।”
চিৎকারের চোটে র্যান্টির পুরো কথা আর শোনা গেল না। লিগ জয়ের পুরস্কার হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা টিমকে দেওয়ার ঘোষণা শেষ ততক্ষণে। টেকনিক্যাল ম্যানেজার অ্যালভিটো ডি’কুনহা আবার ওরই মধ্যে অবিনাশদের বলে এলেন, খেলে যা, এ রকম আরও হবে।
ট্রফি যত বার, পুরস্কারও তত বার।